অন্তরা চৌধুরি
এত দিনে নিশ্চয়ই আমানির সঙ্গে তেলপোড়া আপনাদের হজম হয়ে গেছে। আচ্ছা আপনারা খসলা খেয়েছেন কখনও? জানেন খসলা কী, বা কীভাবে খায়! বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মানুষের কাছে এই খাবারটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। অন্যান্য জেলার কথা বলতে পারব না। তবে কলকাতা, নদীয়া, বা হুগলি জেলার মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাঁরা এই খাবারটির কথা জানেন না। খেতেও তেমন আগ্রহ বোধ করেন না। অনেকেই এই খসলাকে লাল তিল নামে চেনেন।
পোস্তর তো অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়ে না। যেহেতু সাধারণ মানুষের পোস্ত ছাড়া চলে না তাই তেনার এত দেমাক। দাম বাড়ছে তো বেড়েই চলেছে। অথচ এই খসলা একেবারেই সাদামাটা, শান্ত, স্নিগ্ধ। পোস্তর সঙ্গে তুলনায় আসে না যদিও, তবুও এর স্বাদ অনায়াসেই পোস্তকে হারিয়ে দিতে পারে। তাই খসলাকে বলা হয় গরিবের পোস্ত। আসলে খসলা হল দামে কম মানে ভাল। মাত্র ষাট-সত্তর টাকা কেজি। অনেকের মতো আমারও খসলা অত্যন্ত প্রিয়।
তবে আমার মা কখনও খসলা খাননি। কারণ ওনার জন্ম হুগলি জেলাতে হলেও ছোট থেকে বেড়ে ওঠা নদীয়াতেই। কাজেই খসলা, তেলপোড়া, আমানির মতো এইসমস্ত বাঁকড়ি খাবার তিনি মোটেও খান না। কতবার সাধনা করেছি একবার খেয়ে দেখ। ভাল না লাগলে খেয়ো না। কিন্তু তিনি মুখে তোলেননি।
এই খসলাকে বিভিন্ন ভাবে খাওয়া যায়। তবে মুশকিল একটাই। এতে প্রচণ্ড বালি থাকে। তাই খসলার যে কোনও পদ তৈরি করার আগে একে বেশ কিছুক্ষণ জলে ভিজিয়ে রাখতে হয়। বালি থিতু হয়ে নীচে চলে যায়। এইসময় ওপরে ভেসে থাকা খসলাকে সাবধানে ছাকনায় ছেঁকে নিতে হয়। তলার বালি ফেলে দিতে হয়। এইভাবে বার পাঁচেক ধুয়ে নিতে হবে। অনেকটা শাক ধোওয়ার মতো। গ্রাম বাংলার দিকে এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘পেনিয়ে’ নেওয়া। ঠিকমতো পেনানো না হলে খাওয়ার সময় মুখে বালি কিচ্কিচ্ করে।
এবার ওই খসলাকে শিলে বা মিক্সিতে বেটে নিতে হবে। অনেকেই খসলার বড়া খুব পছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে ওই খসলা বাটার সঙ্গে নুন, লঙ্কা, পেঁয়াজ দিয়ে মেখে চাটুতে সামান্য তেল দিয়ে শুকনো শুকনো বড়া করা যায়। আবার পেঁয়াজ পোস্তর আদলেও করা যায় পেঁয়াজ খসলা। পদ্ধতিটা একই। শুধু পোস্তর বদলে খসলা দিতে হবে। এই গরমের দিনে ঝিঙে খসলা খেতেও বেশ লাগে। এই খসলাও কিন্তু ভিজে ভাত বা গরম ভাতের সঙ্গে দুর্দান্ত অনুষঙ্গ। আমরা যেমন বাটি পোস্ত খাই তেমন বাটি খসলা খেতেও দারুণ লাগে। একটা ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছুটা খসলা বাটা নিয়ে তাতে নুন কাঁচালঙ্কা আর কাঁচাতেল দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিলেই রেডি বাটি খসলা।
বাঁকুড়া পুরুলিয়ার দিকে গেলে দেখবেন বিঘার পর বিঘা জুড়ে এই খসলা চাষ হচ্ছে। তবে চাষ করতে যা পরিশ্রম সেই অনুযায়ী বাজার দর পান না চাষীরা। খসলার যে কোনও পদ রান্নার ক্ষেত্রে খুব বেশি তেল লাগে না। কারণ এই শস্যটির শরীরেই যথেষ্ট তেল আছে। বর্ষাকালে ভাতের পাতে খসলার বড়া বা পেঁয়াজ খসলা দারুণ জমে। ভাদ্র মাস বা শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে যাদের পান্তা ভাত হয় তাদের খসলার পদ করা বাধ্যতামূলক। এই খসলার সঙ্গেই কত মানুষের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পিৎজা, বার্গার খাওয়া বর্তমান প্রজন্ম এইসব খাবার চোখেও দেখেনি, চেখেও দেখেনি। কিন্তু আমরা যাঁরা একটু সেকেলে, যাঁদের ভেতর দেশজ টান আর সংস্কারের একটা শিকড় লুকিয়ে আছে তারা তো একবার খেয়ে দেখতেই পারি। বাঁকুড়া গেলেই কাকিমাকে বলি খসলা করতে। কারণ এই জিনিসটি কলকাতায় পাওয়া যায় না। মাছ মাংস ডিমের তুলনায় এই পদ আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
এই ধরণের দেশজ খাবারগুলো কি শুধু মাত্র আমাদের রসনাই পরিতৃপ্ত করে? আমরা যখন খাই, তখন খাওয়াতেই মন দিই। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে এই খাবারগুলোর প্রতিটি কনায় জড়িয়ে আছে উৎপাদনকারীর হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম, আশা, আকাঙ্ক্ষা, এক বুক স্বপ্ন, যা তাকে ঘুমোতে দেয় না। আর যাঁরা প্রতিদিন আগুনের কাছে থেকে আমাদের হাসিমুখে খেতে দেন, তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা আন্তরিকতাও তো জড়িয়ে থাকে সেই খাবারগুলোর পরতে পরতে। এইভাবেই তো একটা সাধারণ খাবার ভালোবাসার টানে হয়ে ওঠে অসাধারণ…।