‌নীল সাহেবের কুঠি

শাশ্বত মজুমদার

পয়লা বৈশাখে ঘুরে এলাম ভাল ভূতের দেশ। জায়গাটার নাম মঙ্গলগঞ্জ। নিউ টাউনে আমার ফ্ল্যাট থেকে ৯৩ কিমি। সেলফ ড্রাইভ অবশ্যই। সকাল সকাল বেরিয়েছিলাম, ঘণ্টা আড়াই লাগল পৌঁছতে। হাবড়া, ঠাকুর নগর, চাঁদ পাড়া হয়ে যাওয়া যায়। আমরা গিয়েছিলাম বারাসাত, হরিণ ঘাটা, চাকদা হয়ে। রাস্তা মোটামুটি, খুব ভাল বলা যাবে না।

মাঝে কোনও ব্রেক ছিল না। মঙ্গলগঞ্জ পৌঁছে গেলাম ১০ টা নাগাদ। ব্যাকপ্যাকার্স ক্যাম্পে ঢোকার রাস্তা বেশ সরু, আলপথ বলা যেতে পারে। একটু বড় গাড়ি হলে অসুবিধে হতে পারে। ক্যাম্পের গেট টাও বেশ সরু, বড় গাড়ি হলে একটু অসুবিধে বইকি। তবে ক্যাম্পের জায়গাটা কিন্তু অসাধারণ।

একদিকে টেন্ট আর একদিকে বাম্বু কটেজ। আমরা কটেজ নিয়েছিলাম। মাঝে একটা সুন্দর বড় লন। গাছপালা ভর্তি। ওখানে আলাপ হল পুষ্পার সঙ্গে। পুষ্পার চোখ দুটো অসাধারণ। একবার তাকালে ফেরানো মুশকিল। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েলকাম ডিঙ্ক। গরম প্রচণ্ড ছিল, অনেক আরাম পেলাম। ব্রেকফাস্টের পর ওখানকার অ্যাটেন্ডেন্টদের সঙ্গে শুরু হল গল্প। এই জায়গায় ছিল নীল সাহেবদের কুঠি, এখানেই হত নীল চাষ। চাষিদের জোর করে নীল চাষ করাতো ইংরেজরা। আর সেই নীল বিদেশে এক্সপোর্ট হত। এক নীল সাহেবকে এক দিন গলা কেটে মেরে ফেলে চাষিরা। সেই থেকে ওই নীল সাহেবের অতৃপ্ত আত্মা নাকি ওখানে ঘুরে বেড়ায়।

সেই নীল সাহেবের কুঠি ক্যাম্প থেকে খুব একটা দূরে নয়। দুপুরে লাঞ্চ করলাম, একদম বাড়ির মতোই খাবার— ডাল, ভাত, তরকারি, মাছ, চাটনি। সাদা সাপটা খাবার কিন্তু খুব সুন্দর স্বাদ। খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জায়গাটা এক্সপ্লোর করতে। নীল সাহেবের কুঠি পার হয়েই ইছামতী নদী, হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। দিনের আলোয় কুঠি দেখে কিন্তু ভয় লাগল না। উল্টে পুরো ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। পুরনো কনস্ট্রাকশন, বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়েছে, ভাঙ্গা সিড়ি, ভগ্নপ্রায় বারান্দা, অনেক ছবিতে তুললাম স্বামী স্ত্রী বাচ্চা মিলে।তারপর গেলাম নদীর দিকে।ওখানে নৌকো বিহারের লোভ সামলাতে পারলাম না। দু ঘণ্টা নৌকো করে নদীতে ঘুরলাম। নদীর ওপাশে পারমাদান অভয়ারণ্য। সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো বলে আর যাওয়া হয়নি। যাই হোক, নৌকো বিহার করে পাড়ে উঠে পার্কে কিছুক্ষণ ঘুরে, চা বিস্কুট খেয়ে ফিরে এলাম ক্যাম্প। ফেরার পথে একটা গ্রামের দোকানে বসে কিছুক্ষণ গপ্পো করলাম দোকানের মালকিনের সঙ্গে। ক্যাম্পে ফিরে বড়সড় চমক ছিল। দুর্দান্ত bar b q এর প্ল্যান হল। ক্যাম্পে ছিল আমাদের মতই আর একটা ফ্যামিলি, আর একটা জনা আটেক কলেজ পড়ুয়া ছেলের গ্রুপ। Bar b q শেষ হওয়ার পর ছিল আসল সারপ্রাইজ। ওখানকার একজন attendant প্রস্তাব দিল আমাদের অন্ধকারে নীল কুঠির দিকে যাওয়ার জন্যে।

সামনে ও যাবে হ্যারিকেন নিয়ে, আর পেছনে আমরা সবাই, ওই ১২/১৪ জন।সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।বলে বোঝানো যাবেনা, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো।

অনেক রকম ভূত আর অশরীরীর গল্প শুনলাম। তার পর হাঁটতে হাঁটতে ইছামতী নদী, উফ্, সে এক এক্সপেরিয়েন্স। নদীর ঘাটে সিড়িতে বসে সবাই যে যার নিজের ভৌতিক অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। এসবের মধ্যেই ঘাটের সিড়িতে হঠাৎ আর একটা যে ফ্যামিলি ছিল, ভদ্রলোকের স্ত্রী পড়ে গেলেন হোঁচট খেয়ে। পায়ের আঙুল কেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। তাঁর মনে হয়েছে কেউ নাকি ওনাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। যাই হোক, সবাই বেশ ভয় পেয়েছিল সে রাতে, ফিরে এলাম ক্যাম্পে। এসে ডিনার সারলাম রুটি/ভাত চিকেন। অসামান্য টেস্ট, এখনও মুখে লেগে আছে। ছেলেদের গ্রুপটা পার্টি করছিল, গিটার বাজিয়ে গান করছিল, বেশ ভাল লাগছিলো পরিবেশটা। আর একটা যে ফ্যামিলি ছিল, ওদের বছর সাতেকের ছেলের সঙ্গে আমার ছয় বছরের মেয়ের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল, সে দুজনের কি গল্প। এসব করতে করতে রাত হয়ে গেল, ঘুমও পাচ্ছিল।

একটা উৎপাত আছে ওখানে, সেটা হচ্ছে আরশোলা আর মাকড়সা, ঘরের মধ্যে। লাল হিট আর mosquito cream অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। আমাদের গোটা সাতেক আরশোলা মারতে হয়েছিল। মজাটা হচ্ছে, দিনের বেলা যেখানে গরমে টেকা যাচ্ছিল না, সেখানে রাতে লাগছিলো ঠান্ডা। ঘরে একটা সিলিং ফ্যান আর একটা স্ট্যান্ড ফ্যান ছিলো, স্ট্যান্ড ফ্যান টা বন্ধ করে ঘুমোতে হলো। সারা দিনের ক্লান্তি ছিল, ঘুমিয়েও পড়লাম। পর দিন সকালে উঠে বেরিয়ে পড়েছিলাম কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে। ওখানকার ঘর গুলোর নাম গুলো অদ্ভুত, পেত্নী, ব্রহমদৈত্য, শাঁখ চুন্নি, ডাইনিং হলের নাম নরখাদক। গুপী বাঘার ভূতের রাজার সঙ্গে selfie মিস করা যাবে না কিন্তু।

সব মিলিয়ে ২২/২৩ ঘণ্টা অসাধারণ কেটেছিল। হয়তো গরম বলে একটু কষ্ট হয়েছে, বর্ষা বা শীত কালে এই জায়গাটার রূপ অসাধারণ হওয়া উচিত, ইচ্ছে আছে শীতকালে আরেক বার ঢু মারার। শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা আর ইট কাঠ পাথরের আবর্জনা থেকে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় সবুজের মাঝে হারিয়ে যেতে হলে একবার ঘুরে আসবেন ‘‌ভালো ভূতের দেশ’‌ থেকে। মিশকালো অন্ধকারে ইছামতির ওপর শয়ে শয়ে জোনাকির মিটমিটে আলো আর সঙ্গে পূর্ণিমার ঝকঝকে চাঁদ পেলে তো কথাই নেই।

ব্যাকপ্যাকার্স ক্যাম্পকে অসংখ্য ধন্যবাদ এরম একটা অসাধারণ জায়গা খুঁজে বের করার জন্যে।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.