বিপ্লব মিশ্র
বাঙালির জীবনে বিজয়া কিনা এসে দাঁড়াল সেই হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকে!
এটাই হয়ত হওয়ার ছিল। কবে বিজয়া শুরু, কীভাবে এর বিবর্তন হল, তা নিয়ে বয়স্ক লোকেরা ভাল বলতে পারবেন। আমরা, যারা জীবনের মাঝবয়সে এসে পৌঁছেছি, তারা বড়জোর নিজেদের সময়টুকুরকথা বলতে পারি।
মনে আছে, নবমীর রাতে হুল্লোড়ের পর দশমীর সকাল থেকেই কেমন একটা বিষণ্ণতা কাজ করত। মনে হত, এই পুজোর আনন্দ নিমেশে শেষ হয়ে যাবে! আজকের পর সব শুনশান হয়ে যাবে! কিছুতেই যেন মানতে পারতাম না।
বিসর্জনের সময় পটকা ফাটানোর সে কী ধুম। সিঁদুর খেলা তখনও ছিল। তবে তাতে বাংলা সিরিয়ালের সেই হাওয়া লাগেনি। এখন সিঁদুর খেলাটাও যেন নিজেকে জাহিরের একটা ইভেন্ট। সিরিয়ালে যেভাবে হয়, সেভাবে। আর ছবি তোলার হিড়িক তো আছেই। একেকজন যে কত সেলফি তোলেন, তার হিসেব নেই। যাঁরা সেলফি তুলতে পারেন না, তাঁদের নিরীহ আবদার, আমাকে কিন্তু ছবিগুলো পাঠাবে।
তখন এত কার্নিভাল–টার্নিভালের বালাই ছিল না। দুপুর নাগাদ মণ্ডপ থেকে প্রতিমা যাবে পুকুরের দিকে। একদিকে ঢাকের আওয়াজ, একদিকে পটকার আওয়াজ। সঙ্গে নানা রকমের চেনা–অচেনা স্লোগান। বলো, দুগ্গা মাই কি জয়। আসছে বছর আবার হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
পুকুর ঘাটের কাছে গিয়ে আরেকপ্রস্থ ঢাক আর পটকার প্রদর্শনী। কেউ কেউ তখন কাঁদছেন। কেউ চোখ মুছছেন। এবার ঠিক হল, কে কে ভাসাতে যাবেন। অনেকে আগাম পুকুরে অপেক্ষায় থাকে, কখন ভাসান হবে। সেউ খুলে নিত মাথার ময়ূরের পালক। কেউ আবার মেড় ধরে ভেসে থাকতে চাইত। মেলায় ফিরে শান্তিজল ছেটানো। যে যার বাড়িতে যাওয়া।
দুপুর বেলায় প্রায় সব ঘরে ঘরে হত আদিবাসী নৃত্য। দল বেঁধে তাঁরা পৌঁছে যেতেন বিভিন্ন ঘরে। বাড়ির ছোটরাও কোমর দোলাতো। বিকেল হলেই প্রণাম অভিযানে বেরিয়ে পড়া। বন্ধুদের বাড়ি। আত্মীয়দের বাড়ি। মাস্টারমশাইদের বাড়ি। কখনও দল বেঁধে, কখনও একা। কোথাও ছিল ঘুগনি, কোথাও গুড়ের মিস্টি, নারকেল নাড়ু, কোথাও পায়েস, কোথাও নিমকি। কেউ কেউ গোপনে পলিথিন নিয়ে যেত। আশেপাশে কেউ নেই দেখলেই পাচার করে দিত সেই প্লাস্টিকে। সত্যিই তো, একদিনে এতকিছু খাওয়া যায়!
এভাবেই সন্ধে গড়িয়ে যেত রাতের দিকে।
সারাদিন একটাও ছবি তোলা ছিল না। এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ নামক শব্দগুলোও ডিকশেনারিতে ছিল না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেইদিনগুলোই বেশ ছিল। লোকগানের সুরেই বলতে ইচ্ছে করে, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’