অজয় নন্দী
রবিবার শব্দটা একেকজনের কাছে একেক রকম ভাবে ধরা যায়। অনেকের কাছেই নির্ভেজাল একটা ছুটির দিন। কারও কাছে দুপুরে খাসি মাংস, ভাত খেয়ে ভাতঘুমে দেওয়ার দিন। কারও কাছে টুকটাক বেরিয়ে পড়ার দিন। ছোটদের কাছে রবিবার মানে খেলাধূলার দিন। কারও কাছে আরও বেশি করে মোবাইল ঘাটার দিন।
আমি বাপু কুঁড়ে মানুষ। আমার কাছে রবিবার মানে বিভিন্ন কাগজের সঙ্গে পাওয়া রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র পড়ার দিন। এমনিতে একটা কাগজ নিই। কিন্তু রবিবার এলে চেষ্টা করি তিন চারটে কাগজ নিতে। অন্য পাতাগুলোকে ঘিরে বিশেষ আগ্রহ থাকে না। মূল আগ্রহ ওই রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্রগুলোকে ঘিরেই। সব যে পড়তে পারি, এমন নয়। চেষ্টা করি, যতটা পড়া যায়।
ভনিতা না করে সরাসরি মূল প্রসঙ্গে ঢোকাই ভাল। প্রায় এক বছর ধরে আমার বড় একটা আকর্ষণ ছিল ‘অফস্টাম্পের বাইরে’। সংবাদ প্রতিদিনের সঙ্গে বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘রোববার’। খুব উন্নতমানের ম্যাগাজিন। সেই শুরু থেকেই পড়ি। আগে সম্পাদক ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, এখন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। এই রোববারেই প্রায় এক বছর ধরে বেরোচ্ছিল সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের ‘অফস্টাম্পের বাইরে’।
প্রায় চার দশকের সাংবাদিক জীবনের নানা ওঠাপড়া নিয়ে দুরন্ত একটি স্মৃতিচারণধর্মী লেখা। ঠিক জীবনী বলা যাবে না। বরং তারকাদের জীবনের নানা অজানা কথা। সেইসঙ্গে ক্রীড়াসাংবাদিকতার নানা বাঁকও উঠে এসেছে লেখকের বলিষ্ঠ কলমে। পেশাগত লড়াইয়ে আবহটা আটের দশকে কেমন ছিল, এখনই বা কেমন। কোনও বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে কেমন প্রস্তুতি নিতে হত, এখন সেই প্রস্তুতির ছবিটা কেমন। সাবেকি কাগজের সাংবাদিকতা থেকে ডিজিট্যাল মিডিয়ার বিবর্তন। কোন সাক্ষাৎকার পেতে গিয়ে কেমন কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আবার কোন খবরটা মেঘ না চাইতেই জলের মতো ধরা দিয়েছে। রাতের শেষে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া, পরদিন কোন কাগজে কোন কপি বেরিয়ে যাবে। সতীর্থদের ভূমিকাই বা কেমন, পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভূমিকাই বা কেমন। কোনও একপেশে আলোচনা নয়। অকপটে সেই সময়ে নিজের ভেতর চলা নানা ঘাত–প্রতিঘাতও ধরা দিয়েছে। স্মৃতির আলপথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কখনও কঠোর আত্মসমালোচনাও করেছেন। একটা লেখা, চারপাশের ছবিটাকে কী নিপুণভাবে ক্যানভাসে ধরতে পারে।
বিশ্ব খেলাধূলার জগৎকে এত কাছ থেকে কজন বাঙালি সাংবাদিক দেখেছেন? বড়জোর তাঁর সঙ্গে দেবাশিস দত্তর নাম আনা যেতে পারে। তৃতীয় কোনও নাম? চোখে হাই পাওয়ারের দূরবিন লাগিয়েও দেখা যাচ্ছে না। পিকে–অমল, উত্তর–সৌমিত্রর মতোই দেবাশিস–গৌতম দ্বৈরথও প্রায় চার দশক ধরে উপভোগ করেছে বাঙালি পাঠক। একজন একের পর এক খবর করে চমকে দিয়েছেন। অন্যজন দুরন্ত লেখনিতে বাঙালিকে আবিষ্ট করে রেখেছেন।
যাঁরা এই কলমের স্বাদ পেয়েছেন, তাঁরা অদ্ভুত এক মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। কিন্তু এই প্রজন্মের ক্রীড়া সাংবাদিকরা কি সত্যিই পড়লেন? সত্যিই কিছু শিখলেন? সেটাই মোক্ষম প্রশ্ন। একটা আস্ত প্রজন্ম লাইক দিতে আর লাইক গুনতেই ব্যস্ত। তাঁদের কাছে অন্যের লেখা পড়ার সময় কোথায়? এমন একটা দুরন্ত ধারাবাহিক নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেল। হয়ত পরে বই হয়ে বেরোবে। থেকে যাবে মহাকালের কাছে দলিল হয়ে। গুণগ্রাহী পাঠক নিশ্চয় আছেন। কিন্তু যাঁদের সবার আগে পড়ার কথা, সেই সাংবাদিকরা বা সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা হয়ত সেই পাঠকবৃত্তের বাইরেই থেকে যাবেন। এটাই সবথেকে বড় ট্র্যাজেডি।