‌ঝোলা থেকে বেড়ালটা তাহলে বেরিয়েই পড়ল

ধীমান সাহা

মাঝে মাঝেই অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘‌কে কী বলল, আমার কিছু যায় আসে না। আমি ওসব নিয়ে ভাবি না।’‌

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘‌যাঁরা এমনটা বলেন, আসলে তাঁরা সবথেকে বেশি ভাবেন। তাঁদেরই সবথেকে বেশি যায় আসে। সেই কারণেই আগ বাড়িয়ে এমন দাবি করেন।’

আমাদের বিরাট কোহলির হয়েছে সেই অবস্থা। প্রায় তিন বছর ব্যাটে শতরান নেই। টেস্ট, একদিনের ম্যাচ, টি২০, আইপিএল–‌কোনও ঘরানার ক্রিকেটেই শতরান নেই। নানা মহলে টুকটাক সমালোচনা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ‌বরং তাঁর ক্ষেত্রে সমালোচনা কমই হয়েছে। তাঁর অতীতের পারফরমেন্সকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই সবাই স্মরণ করেছেন। অধিকাংশ প্রাক্তনই বলেছেন, বিরাট অনেক বড় মাপের ব্যাটসম্যান। আবার তিনি ঠিক ছন্দে ফিরে আসবেন। অতীতে আর কোনও ক্রিকেটারকে এতখানি রেয়াত করা হয়নি।

কিন্তু এরপরেও দেশশুদ্ধু সবাইকে কার্যত শত্রু মনে করছেন বিরাট কোহলি। একজনের খারাপ সময় যেতেই পারে। সেই অবস্থায় তিনি আরও পরিশ্রম করবেন, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে সেই পরিশ্রমের চেয়েও তার দেখনদারিটা অনেক বেশি প্রকট ছিল। জিম করছেন, বাড়িতে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন, সবকিছুই পোজ দিয়ে ছবি। সেই ছবি তিনি শেয়ার করছেন জনসমক্ষে। এতে আগুনে ঘৃতাহুতিই পড়ে। বিরাটের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।

একজন রান পাচ্ছেন না। তিনি যদি ক্রমাগত বিকট বিকট ছবি পোস্ট করে যান, সমালোচনা আরও বিরূপ হওয়ারই কথা। তবু বিরাট সৌভাগ্যবান। এইসব ছবি কাগজে ছাপা হয়েছে। এইসব ছবিতে লক্ষলক্ষ লাইক পড়েছে। আর এই লাইক আর কমেন্টেই বিভোর থেকেছেন কোহলি।

মোদ্দা কথা, ব্যাটিং থেকে ফোকাসটা সরে গিয়েছিল। তার থেকে অনেক বেশি মনযোগ ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কোন ছবিটা ছাড়তে হবে, কোন ছবিতে কটা লাইক পড়ল, কে কী বলছে, এসব চিন্তা তাঁকে অনেক বেশি আচ্ছন্ন রেখেছিল। তাই সুযোগ খুঁজছিলেন, একদিন রান পেলেই সমালোচকদের ফের একহাত নেবেন। দু–‌চার কথা শুনিয়ে দেবেন।

সেটাই হল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৬০ রান করতেই আর তর সইল না। প্রেস কনফারেন্সে এসে বলে বসলেন, ‘‌যাঁরা টিভিতে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছেন, আমার কাছে তাঁদের পরামর্শের কোনও মূল্য নেই।’‌ এমনটা না বললেও চলত। কোনও প্ররোচনা ছিল, এমনও নয়। যদি এমন প্রশ্ন আসতও, তাহলেও অফস্টাম্পের বাইরের বল মনে করে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু যেভাবে অফস্টাম্পের বাইরের বল খোঁচা দিয়ে গত তিন বছর ধরে আউট হয়েছেন, এখানেও ঠিক তেমনটাই করলেন। হয়ত ঠিক করেই এসেছিলেন, প্রশ্ন না এলেও তিনি এমন উত্তরই লিখবেন।

একবারও ভেবে দেখলেন না, দল পাকিস্তানের সঙ্গে হেরেছে। টি২০ বিশ্বকাপের মতোই এশিয়া কাপেও বিদায়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরের ম্যাচে হারলেই ভারত কার্যত বিদায়। তাছাড়া, পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর ব্যাটে ৬০ রান এসেছে ঠিকই, কিন্তু পঞ্চাশে পৌঁছনোর জন্য তাঁর আকূলতাটা কারও নজর এড়ায়নি। সেই সময় অনেক সাবধানী ব্যাটিং করছিলেন। তাই ওই মোক্ষম সময়ে রানের গতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে এসেছিল। নইলে আরও অন্তত কুড়ি রান বেশি উঠতে পারত। সেক্ষেত্রে ভারতকে হয়ত হারতে হত না। ম্যাচের পর সবাই ক্যাচ ফেলার জন্য অর্শদীপকে দুষছেন ঠিকই, কিন্তু রানের গতি মন্থর করার পেছনে বিরাটের ভূমিকাও কম নয়। অথচ, তিনিই কিনা ভাষণ দিলেন, ব্যক্তিগত স্কোর বা মাইলস্টোন বড় নয়, দলের জন্যই খেলি। তিরিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝে যেভাবে ব্যাট করলেন, তাতে অন্তত এই কথাটা বলা যায় না।

যাই হোক, মোদ্দা কথা, সেই খোলস ছেড়ে বেরিয়েই এলেন। মনের ভাবটা সেই বেরিয়েই এল। বোঝাই গেল, কে কী বলছে, এই ভাবনাটাই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। একটু বেশিই এসব নিয়ে ভাবছিলেন। নইলে, ম্যাচের পর এই মঞ্চটাকে বেছে নিতেন না। ঝোলা থেকে বেড়ালটা তাহলে বেরিয়েই পড়ল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.