সৃজন শীল
দিন দুই আগের ঘটনা। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে অরুণাভ ঘোষ। কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। পরে মোটামুটি মিটমাট।
সেখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যথারতী খেউড় পর্ব শুরু। টার্গেট অরুণাভ ঘোষ।
টুকটাক কিছু লেখা। তার নিচে অন্তত হাজার খানেক মন্তব্য। যেসব মন্তব্যের প্রায় আশি ভাগ অত্যন্ত নিম্নরুচির আক্রমণ। অসহিষ্ণুতার চূড়ান্ত নিদর্শন।
যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল, সেখানে অরুণাভ ঘোষের ভূমিকা নিয়ে কেউ সমালোচনা করতেই পারেন। কারও মনে হতেই পারে, তিনি এতখানি না বললেই পারতেন। কিন্তু তাঁকে তৃণমূলের দালাল থেকে চটিচাটা উকিল— কী নাই বলা হল। এসব ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লবীরা যা করে থাকেন, রায় দিয়ে বসলেন, অরুণাভবাবু তৃণমূলের যাওয়ার ছক কষছেন।
কার সম্পর্কে কী বলছেন, এঁরা ভেবেও দেখেন না। এঁরা না জানেন অতীত। না বোঝেন বর্তমান। আর না দেখতে পান সামনের ছবিটা।
গত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে যে মানুষটা সরকারের নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন, তাঁকে একটা তুচ্ছ কারণে এভাবে অপমান করা যায়! এভাবে তৃণমূলের দালাল বলা যায়! বলা হল, তিনি নাতি অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ের হয়ে মামলা লড়তে গিয়েছিলেন। তৃণমূলকে খুশি করে বার্তা দিলেন।
তিনি যে অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ের হয়ে লড়তে গিয়েছিলেন, এ কথা কোথা থেকে জানা গেল! তিনি তো অনুব্রত–কন্যার হয়ে কোনও সওয়াল করেননি। বিচারপতির কিছু রায়দানের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে তো তিনি আগেও একাধিক ইন্টারভিউতে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। এটা ঘটনা, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুদিন পর সক্রিয় একটা অবস্থান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর রায়গুলো ব্যকরণভাবে কতটা আইনসিদ্ধ, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় অনেককিছুই প্রমাণ করা যাবে না। বর্ষীয়ান আইনজীবী অরুণাভবাবু বারবার সেই সংশয়ই প্রকাশ করেছেন।
তার মানেই তিনি তৃণমূল হয়ে গেলেন? এত সরলীকরণ করে ফেলা যায়! হ্যাঁ, অরুণাভবাবু একসময় তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। স্বল্প সময়ে বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছেন। সবথেকে বড় কথা, মূল্যবোধের এক বিরল দৃষ্টান্ত রেখেছেন। যখনই তৃণমূলের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না, সবার আগে বিধায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। বাংলার রাজনীতিতে এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। কত লোক দল ছাড়েন, কিন্তু বিধায়ক বা সাংসদ পদ আঁকড়ে থাকেন। সেখানে উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম এই মানুষটা।
গত দশ বছর ধরে কখনও আদালতে, কখনও টিভির বিতর্কে, কখনও পথসভায় চাঁছাছোলা ভাষায় বেআব্রু করেছেন সরকারের একের পর এক বেআইনি কর্মকাণ্ডকে। এই তো সেদিন, বার অ্যাসোসিয়েশনের লড়াইয়ে তাঁকে হারাতে একরকম কোমর বেঁধে নেমেছিল শাসক দল। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে এলেন। তারপরেও তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের অসভ্যতার বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন। হেনস্থার শিকার হলেন। তবু লড়াই থেকে পিছিয়ে আসেননি। হ্যাঁ, তাঁর কথাবার্তা একটু বেশিই চাছাছোলা। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতেই অভ্যস্থ। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নাক দেখানো নয়, যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই স্পষ্টভাষায় বলেন। তিনি লড়াই করেন তাঁর মতো করেই।
সেই মানুষটাকে এভাবে হেনস্থার শিকার হতে হল! সেই মানুষটার সম্পর্কে যা মুখে এল, বলে দিলেন! এই বীর বিপ্লবীরা ফেসবুক ছাড়া কোথায় বিপ্লব করেছেন, জানতে খুব ইচ্ছে হয়।
অরুণাভবাবু মাঝে মাঝেই বলেন, অশিক্ষা মানুষকে কোথায় টেনে নামায়! নিজে সেটা আরও ভালভাবে টের পেলেন। পান থেকে চুন খসলেই কোনওকিছু খতিয়ে না দেখে রে–রে করে তেড়ে আসা একদল মানুষ বিধান দিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রেও তাঁরা পিছিয়ে রইলেন না। অসহিষ্ণুতার ট্র্যাডিশনই বজায় রাখলেন।
অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হয়ে থাকেন, তবে মনে রাখবেন অরুণাভ ঘোষও দীর্ঘ সময় ধরে এই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। এই দুজনের মতপার্থক্য বা বিতণ্ডা হলেও সেটা সাময়িক। এটাকে খুব বড় করে দেখানো মানে এই লড়াইটাকেই আরও দুর্বল করে দেওয়া।
যাঁরা রে রে করে তেড়ে উঠলেন, তাঁরা একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন তো। এতখানি অসহিষ্ণুতা না দেখালেই চলছিল না!