আজ যাঁরা নানা বাধ্যবাধকতায় ব্রিগেডে, তাঁদের অনেকেই এখনও মনে মনে লাল পতাকা নিয়েই হাঁটছেন। আবার একদিন লাল পতাকার নিশ্চিত আশ্রয়েই ফিরে আসবেন। সেই গরিব গুর্বো মানুষগুলোর ডিম–ভাত খাওয়াকে কটাক্ষ করতে গিয়ে তাঁদের আরও দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন না তো? ডিম–ভাত নিয়ে হইচই করতে গিয়ে আসল সমালোচনার জায়গাগুলো আড়াল করে ফেলছেন না তো? লিখেছেন রক্তিম মিত্র।।
গত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনকী মূলস্রোত মিডিয়ায় ডিম–ভাত নিয়ে অনেক রকম কটাক্ষ শোনা গেল। এটা শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে থেকে। ২১ জুলাই তৃণমূলের সমাবেশে আসা মানুষদের ডিম–ভাত খাওয়ানো হয়েছে, এই ছবিগুলো তিন দিন ধরে দেখানো হল বিভিন্ন চ্যানেলে। বিভিন্ন কাগজে সেই ছবি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সেইসব ছবি ঘুরে বেড়াল। যাঁরা নেত্রীকে খুশি করতে চান, তাঁরা যেমন ছড়ালেন। ঠিক তেমনি যাঁরা নেত্রীর ‘অনুপ্রেরণা’য় চলেন না, তাঁরাও ছড়ালেন।
গ্রামের গরিব মানুষদের হেয় করা শহুরে বাঙালির অনেকদিনের ট্র্যাডিশন। কোনও সভা বা মিছিল মানেই প্রচার হয়, গ্রামের লোক ট্রেনে চড়তে পায় না। কলকাতা শহর ঘুরতে এসেছে। মাছ–ভাত, ডিম–ভাত খাওয়ার লোভে এসেছে। বামেদের ব্রিগেডের ক্ষেত্রেও দিনের পর দিন এমন প্রচার হয়েছে, তৃণমূলের সমাবেশের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। আমার মনে হয়, এটা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার।
হ্যাঁ, গ্রামের মানুষ ব্রিগেডে আসেন। বছরের পর বছর তাঁরাই ব্রিগেড ভরিয়ে এসেছেন। কলকাতার সুখী মানুষেরা ড্রয়িং রুমে বসে থাকবেন, সোশাল সাইটে কটাক্ষ ছুঁড়বেন। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে থাকবেন না। লড়াই করার জন্য, ভিড় জমানোর জন্য এগিয়ে দেওয়া হয় সেই গ্রামের মানুষকেই। আর আমরাও কটাক্ষের জন্য বেছে নিই ওই গ্রামের মানুষকেই। তাঁদের ডিম–ভাত খাওয়াটাকেই বড় করে দেখি। সেটাই বড় করে দেখানো হয়।
যাঁরা আসেন, কেউ ভালবেসে আসেন। কেউ আবার বাধ্য হয়েও আসেন। মনে রাখবেন, কোনওরকম জনভিত্তি ছাড়া এত বড় জমায়েত হয় না। আবার এটাও ঠিক, সরকারে থাকার সুবাদে অনেক মানুষ অনেকরকম সুবিধা পেয়েছেন। তাঁদের কাছে তার পাল্টা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেওয়া হয়। যাঁর মেয়ে কন্যাশ্রীর সাইকেল পেয়েছে, যিনি আমার বাড়ি প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন, যাঁরা পঞ্চায়েতের সুবাদে নানা সুবিধা পেয়েছেন, তাঁদের ওপর কম–বেশে একটা চাপ থেকেই যায়। সেই কৃতজ্ঞতা হিসেবে তাঁদের আসতে হয়।
আবার কারও ক্ষেত্রে সেই সুবিধার টোপ ঝোলানো হয়। যদি ছেলেটার সিভিক পুলিসে চাকরি হয়, যদি মেয়েটা কোথাও একটা কাজ পায়, এসব প্রত্যাশাও হয়ত অনেকের থাকে। যাঁরা আসছেন, তাঁরা সবাই যে তৃণমূল–পন্থী, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অনেকের সামনে অনেক রকম বাধ্যবাধকতা। হয়ত মনে মনে অনেকেই এখনও লাল পতাকাটাই ধরে আছেন। ঠিকঠাক ভরসার জায়গা তৈরি হলে, এঁদের অনেকেই হয়ত আবার সেই লাল পতাকাই তুলে নেবেন। ডিম–ভাত নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে সেই মানুষগুলোকে আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন না তো!
কোনও সন্দেহ নেই, তৃণমূলের এবারের ব্রিগেডে কত খরচ হয়েছে, তার কোনও হিসেব নেই। সবটার হিসেব পাওয়াও যাবে না। এমনকী তৃণমূল নিজেও সেই হিসেব খুঁজে পাবে না। কারণ, কোথায় কত খরচ, তা লিখে রাখার জন্য চিত্রগুপ্তের খাতাও যথেষ্ট নয়।
১) যে বাস মালিক বাস দিলেন, তিনি কি আদৌ টাকা পেলেন? কেউ হয়ত তেলের দাম পেলেন। কেউ তাও পেলেন না। তিনি জানেন, এই দিনে বাস না দিলে এলাকায় বাস চালানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
এমন কত বাস এসেছে? সেইসব বাসের আসা–যাওয়ার খরচ কত? অন্তত এক কোটি।
২) তৃণমূলের জেলা স্তর তো ছেড়ে দিন। ব্লক স্তর, এমনকী পঞ্চায়েত স্তরের নেতারাও বাস বা ট্রেনে চড়া ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা নিদেনপক্ষে স্করপিও, বোলেরো ছাড়া কলকাতায় আসার কথা ভাবতেই পারেন না। বিভিন্ন জেলা থেকে এমন কত গাড়ি এসেছে? উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোকে যদি হিসেবের বাইরেও রাখেন, তাহলেও এমন গাড়ির সংখ্যা অন্তত হাজার। খরচ অন্তত ২ কোটি। নেতার সঙ্গে সাঙ্গোপাঙ্গোরাও থাকেন। তাঁরা কিন্তু ডিম–ভাতের বান্দা নন। সেন্ট্রাল পার্ক বা গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে থাকার পাবলিকও নন। খাদ্য–পানীয় ও কলকাতার এসি হোটেলের খরচ মিলিয়ে কত দাঁড়াতে পারে?
৩) যারা নানা সরকারি কাজের বরাত পেয়েছেন, দশ হাজার খরচ করে দশ লাখের বিল ধরিয়েছেন, তাঁরা এই সময় কী কী প্রতিদান ফিরিয়ে দিলেন, তার কোনও স্পষ্ট হিসেব থাকা সম্ভব নয়।
৪) এত এত প্যান্ডেল। থাকার ব্যবস্থা। যাঁরা করলেন, ঠিকঠাক টাকা পেলেন তো? তাঁরা আগে সরকারি কাজের বরাত পাননি তো? সেখানে বড় অঙ্কের বিল করে এখানে সেটা পুষিয়ে দিলেন না তো?
৫) যাঁরা এত এত হোর্ডিং টাঙালেন, তাঁরা কারা? যাঁরা সারা বছর লক্ষ লক্ষ হোর্ডিংয়ের বরাত পান, তাঁদের অদৃশ্য সাহায্য নেই তো!
৬) যাঁরা টানা কয়েকদিন ধরে প্রচার করে গেলেন, তাঁরাও সারা বছর ধরে কোটি কোটি টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে আসছেন। সেই কৃতজ্ঞতা ফিরিয়ে দেওয়ার তাগিদ থাকাটাই স্বাভাবিক।
অর্থাৎ, চার–পাঁচদিন আগে থেকে যে এত প্রচারের ঢক্কা নিনাদ, তা কিন্তু সেই বিজ্ঞাপনের জন্যই। এই টাকাও কিন্তু গেছে জনতার ট্যাক্সের টাকা থেকেই।
৭) যে সমস্ত সরকারি হল ব্যবহার করা হল, সেগুলোর ঠিকঠিক অনুমতি নেওয়া হয়েছিল তো? তার জন্য যা ভাড়া, সেটা সরকারি খাতে জমা হয়েছে তো? ধরা যাক, সেন্ট্রাল পার্ক। বইমেলায় একটা দশ ফুট বাই দশ ফুটের স্টল নিতে কত খরচ পড়ে? সেখানে পুরো মাঠটা প্রায় সাতদিন ধরে নিলে কত খরচ হতে পারে? বিধাননগর পুরসভায় সেই টাকা জমা পড়েছে তো?
৮) দলের কাজে কয়েক মাস ধরে এত এত পুলিশকে খাটানো হল, পুলিশে পুলিশে এলাকা মুড়ে ফেলা হল, তার জন্য পুলিশের কত তেল পুড়ল, কত কর্মদিবস নষ্ট হল, কে জানে!
আরও এমন অনেক খাত আছে, যেখানে খরচের হিসেব নেই। হিসেব থাকার কথাও নয়। সব খরচ ধরলে নিশ্চিতভাবেই তা কয়েক শো কোটি ছাপিয়ে যেতেই পারে। তাই ডিম–ভাতে কত খরচ হল, এটাকে বড় করে না দেখানোই ভাল। মোট খরচ যদি একশো কোটি হয়ে থাকে, গ্রামের মানুষের ডিম–ভাতের পেছনে খরচ বড়জোর কুড়ি থেকে তিরিশ লাখ।
ঠিকঠাক খোঁজ নিয়ে দেখুন, ডিম ভাতের পেছনে যত খরচ হয়েছে, টানা তিন মাস ধরে জনৈক পিসি এবং কীর্তিমান ভাইপোর ছবিতে তার পাঁচশো গুন খরচ হয়েছে।
যাঁরা ডিম–ভাত নিয়ে কটাক্ষ করছেন, তাঁরা ভেবে দেখুন, এই বিষয়টা নিয়ে কটাক্ষ করতে গিয়ে নিজেদের প্রচারকে কত লঘু করে তুলছেন! কয়েক লাখ খরচের জন্য হইচই করতে গিয়ে কয়েকশো কোটিকে পেছনে ফেলে এলেন। গরিব মানুষের ডিম–ভাত, নাকি রাজ্যজুড়ে ছবির ছয়লাপ, কোনটাকে সামনে আনবেন, নিজেরাই ভেবে নিন।