বৃষ্টির ধারা ও জঙ্গলের মাঝে অনন্ত ধারাগিরি

বিশ্বজিৎ ঘোষ

সদ্য একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, ঝুড়ো লালমাটি বৃষ্টির জল পেয়ে জমাট বেঁধে গেছে। চারপাশের গাছপালা, ঝোপঝাড়গুলি যেন কালচে সবুজ হয়ে গেছে। শুধু কালচে বললে ভুল বলা হবে, সবুজের যে এত প্রকারভেদ থাকতে পারে, তা বর্ষাকালে এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। চারপাশে টিলা, তার মধ্যে দিয়ে হালকা চড়াই পথ বেয়ে হাঁটতে বেশ লাগছে। এমন সময় পিছন থেকে আমার সহকর্মীর ডাকে হুশ ফিরল। সে চেঁচিয়ে বলছে, ‘বাকি পথটা কি হেঁটেই যাবে?’ সত্যিই তো, অনেকটা এগিয়ে এসেছি। চেঁচিয়ে বললাম, ‘তোমরা এসো, আমি এখান থেকে উঠে পড়বো।’

আসলে, আমাদের অটোটা চড়াই বেয়ে উঠতে না পারার জন্য আমরা সবাই নেমে পড়েছি। আমরা বলতে আমি আর আমার দুই কনিষ্ঠ সহকর্মী। ওরা অটোর সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে উঠছে। আমি একা হাঁটতে হাঁটতে একটু বেশিই এগিয়ে গেছি। কলকাতা থেকে ভোরের ইস্পাত ট্রেনে চেপে ঘাটশিলায় এসে সেখান থেকে একটা অটো ঠিক করে প্রথমেই ধারাগিরির দিকে রওনা দিয়েছি। বুরুডি জলাধারের পাশে যে অস্থায়ী পরিকাঠামো যুক্ত খাবার জায়গাগুলো আছে, তারই একটিতে দেশি মুরগির ঝোল আর ভাতের বরাত দিয়ে চলেছি ধারাগিরির উদ্দেশ্যে। মাঝপথে এই ক্ষুদ্র বিপত্তি। অবশেষে একটু সোজা পথ পেয়ে অটো পৌঁছে দিল ধারাগিরির দোরগোড়ায়। যেখানে নামলাম, সেটা একটা উপত্যকার মতো। চারদিক সবুজ পাহাড়ে ঘেরা মাঝখানে ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা সরু লালমাটির পথ সোজা জঙ্গলে চলে গেছে। ওই পথ ধরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা গেলেই ধারাগিরি ঝর্ণা। আমরা একজন আদিবাসী মহিলাকে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে গাইড হিসাবে নিলাম। যদিও এখানে কোনও গাইডের দরকার পড়ে না। কারণ, একটাই পথ সোজা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধারাগিরি পর্যন্ত চলে গেছে। ভুল হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। কিন্তু মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে একজনকে সঙ্গে নিলে এদের একটু উপার্জন হয় এই আর কি। তাছাড়া এরা কিন্তু কোনও সাহায্য চাইছে না, কাজের বিনিময়ে অর্থ চাইছে, এটুকু তো করা যেতেই পারে।

মিনিট পনেরো কুড়ি জঙ্গলের লালমাটির পথ। কখনও আবার নুড়ি পাথরের পথ। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঝর্ণার সামনে পৌঁছে গেলাম। ফেরার পথ চিনতে আর কোনও সমস্যা হবে না বুঝে মহিলাটিকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। সে যেতে চাইছিল না। আমাদেরকে নিয়েই ফিরতে চাইছিল। কিন্তু আমরা একটু বেশিক্ষণ থাকব। তাই অযথা আটকে রেখে লাভ নেই, যদি ফিরে গিয়ে আর কোনও পর্যটক পায়, তাহলে ওরই সুবিধা। এখানে জঙ্গলটা একটু বেশি ঘন হওয়ার দরুন চারদিকটা একটু অন্ধকার মতো। আমরা তিনজন ঝর্ণার পাশে একটা বড়ো পাথরের উপর বসে ঝর্ণার অবিরাম জল পড়ার শব্দ শুনতে থাকলাম। যেন মনে হচ্ছে হিমালয়ের কোনও স্বল্প পরিচিত জায়গায় বসে আছি। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। এমন সময় ঝেপে বৃষ্টি নামল। কিন্তু আমরা সেভাবে ভিজলাম না। চারদিকে অসংখ্য ছোট–‌বড় গাছ। মাথার উপর যেন পাতার একটা ছাউনি তৈরি হয়েছে। তারপর বৃষ্টি কমতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জঙ্গল থেকে বেরিয়ে চললাম বুরুডি লেকের দিকে। আগে থেকে দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়াই ছিল। খেতে বসে গেলাম নির্ধারিত দোকানে। ধুমায়িত দেশি মুরগির ঝোলের সঙ্গে যখন গরম ভাত উদরস্থ করছি, এমন সময় আবার ঝেপে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির জল যখন জলাধারে আছড়ে পড়ছে, মনে হচ্ছে, সমস্ত জলাধারটির উপর কেউ যেন সাদা মশারি খাটিয়ে দিয়েছে। যা দেখলাম, হয়ত কোনওদিন ভুলতে পারব না। ঘন্টা দেড়েক সময় কাটিয়ে চললাম ফুলডুঙড়ি পাহাড়ের দিকে। মন চাইছিল আরও বেশ কিছুক্ষণ সময় এই বুরুডি লেকের ধারে কাটাই। কিন্তু ফিরতে হবে নিজ নিকেতনে। ফুলডুঙড়ি পাহাড়ের পরিবেশ দেখে বুরুডি, ধারাগিরি থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা একরাশ ভালোলাগা, মুগ্ধতা কর্পূরের মতো উবে গেল। তড়িঘড়ি পাহাড় থেকে নেমে চললাম সুবর্ণরেখা নদীর ধারে। একে একে চিত্রকুট পাহাড় আর রুঙ্কিনী মায়ের মন্দির দেখে হৃত ভালোলাগা, মুগ্ধতা পুনরুদ্ধার করে ক্লান্ত শরীরে এসে পৌঁছালাম ঘাটশিলা স্টেশনে । বারবিল জনশতাব্দী ট্রেন আসতে নির্ধারিত কামরায় সংরক্ষিত আসনে শরীরটা পিছনের দিকে এলিয়ে দিতেই চোখের পাতা বুজে এল। কিন্তু কানে ভেসে আসতে লাগল অবিরাম পাথরের উপর পড়ে চলা জলের ক্ষীণ শব্দ।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.