খাল কেটে নরেন ডেকে আনল ফ ব

(‌কিংবদন্তি বাম নেতা অশোক ঘোষের শততম জন্মদিন। ঠিক পাঁচ বছর আগে, তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্য সম্পাদক হয়েছিলেন নরেন চ্যাটার্জি। এখনও তিনিই রাজ্য সম্পাদক। দলের পতাকার রঙ বদলে গেছে। লাল রঙ সরিয়ে কাদের কী বার্তা দিতে চাইছেন?‌ বছর পাঁচেক আগে বেঙ্গল টাইমসে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, খাল কেটে নরেন ডেকে আনল ফব। পঁাচ বছর পর সেই লেখাটি পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে।)

 

সরল বিশ্বাস
কার জায়গায় কে এলেন!‌ কোথায় অশোক ঘোষ আর কোথায় নরেন চ্যাটার্জি। আপনি মানুন আর নাই মানুন, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদকের নাম এখন নরেন চ্যাটার্জি। কোনওভাবে অশোক ঘোষ যদি বেঁচে উঠতেন, যদি প্রতিদিনে মতো সকালে খবরের কাগজে চোখ বোলাতেন, যদি দেখতেন তাঁর শূন্য আসনে যিনি বসছেন, তাঁর নাম নরেন চ্যাটার্জি, আমি নিশ্চিত তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানাতেন।

সাতের দশকে কলকাতা ফুটবলের একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ইস্টবেঙ্গলের দুই রিক্রুটার জীবন চক্রবর্তী ও পল্টু দাস (‌ময়দান যাঁদের জিপ নামে চিনত)‌। কোচেদের পছন্দের ফুটবলারদের যেভাবে হোক, ধরে এনে দিতেন। একদিন তেমনই এক ফুটবলার একটা সহজ গোল নষ্ট করলেন। জীবন চক্রবর্তী হঠাৎ মাঠে ঢুকে গেলেন। সেই ফুটবলারকে বলে বসলেন, ‘‌হ্যাঁ রে, আমরা নয় ফুটবল বুঝি না। কোচ যাকে ধরে আনতে বলে, এনে দিই। তুই তো ফুটবলার। তুই বুঝিসনি তোর ইস্টবেঙ্গলে খেলার যোগ্যতা নেই?‌ তুই কেন আমাকে বললি না, আমাকে নেবেন না।’‌

রাজনীতিতে নরেন চ্যাটার্জিকে কে এনেছিলেন, জানি না। থাকলে তিনি নিশ্চয় এই প্রশ্নটা করতেন। আমাদেরও এই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আপনি তো জানতেন, অশোক ঘোষের এক আলোকবর্ষ দূরত্বেও আপনি নেই। আপনার একবারও মনে হল না, এই চেয়ারে বসার যোগ্যতা আপনার নেই?‌ মানছি, অশোক ঘোষের মতো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী রাজনীতিক এই বাংলায়, এমনকী এই দেশেও খুব বেশি আসেননি। তাঁর বিকল্প তাঁর মতো হবেন না, এটা জানা কথা। তাই বলে তাঁর বিকল্প নরেন চ্যাটার্জি?‌ দলে এত সব ‘‌বিচক্ষণ’‌ নেতার ভিড়। কারও মনে হল না, এটা বড্ড বেশি বেমানান হয়ে যাচ্ছে?‌ নেতাজির প্রতিষ্ঠিত দলে আর কেউ ছিলেন না যিনি রাজ্য সম্পাদক হতে পারতেন?

ashok ghosh4

‌অনেক পুরনো একটা প্রবাদ। একজন মানুষ কেমন, তা তার চারপাশের সঙ্গীদের দেখে বোঝা যায়। নরেনবাবুর চারপাশের অনুগামীদের কথা একবার চিন্তা করুন, তাহলেই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিভিন্ন জেলায় তাঁর অনুগামী আছেন। তাঁরা কারা, একটু খোঁজ নিন। সবার সব গুণ থাকে না। কিন্তু কিছু দিক তো থাকতে হয়, যা সতীর্থদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। নরেন চ্যাটার্জির এমন কোন গুনটা আছে যার জন্য তার দলের লোকেরা গর্ব করতে পারেন?‌ ১)‌ জনপ্রিয়?‌ যত কম বলা যায়, ততই ভাল। অন্য দল ছেড়ে দিন, ফরওয়ার্ড ব্লকেই এমন অন্তত একশো পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য ছিলেন, যাঁদের জনপ্রিয়তা অন্তত নরেনবাবুর থেকে ঢের বেশি ছিল। ২)‌ গ্রহণযোগ্য?‌ যাঁদের কিছু পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে কিছুটা থাকতে পারে। এর বাইরে নেই। ৩)‌ সুবক্তা?‌ যাঁরা টিভিতে তাঁর যুক্তিহীন, সারবত্তাহীন চিৎকার শুনেছেন, তাঁরা জানেন। ৪)‌ সৎ?‌ ওপার বাংলার সেই প্রবাদটা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘‌আস্তে কন কত্তা, ঘোড়ায় হাসব।’ ৫)‌ রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও বিচক্ষণতা?‌ কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন। না বোঝেন নেতাজিকে, না বোঝেন বামপন্থী রাজনীতিকে। তিনি দক্ষিণপন্থী দলে না থেকে বাম দলে আছেন, এটা নিছকই এটা দুর্ঘটনা। ৬)‌ এবার বিধানসভায় যেভাবে ও যে মানদন্ডে প্রার্থীবাছাই হয়েছে, কোনও বাম দলে এমনটা হয়েছে বলে মনে হয় না। ৭)‌ যে কয়েকজন বামপন্থী তৃণমূলের সঙ্গে চমৎকার এক ভারসাম্য ও বোঝাপড়া রেখে চলেন, সেই তালিকায় সামনের সারিতেই তাঁর নাম থাকবে। ৮)‌ দলকে ভালবাসেন?‌ কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারবেন। উদয়ন গুহর মতো তিনিও যদি উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল হয়ে যান, এতটুকুও অবাক হবেন না।

হ্যাঁ, এই আশঙ্কাটাই সবথেকে বেশি। জয়ন্ত রায় বা হাফিজ আলম সৈরানি যদি হতেন, অন্তত এই আশঙ্কাটা থাকত না। তাঁরাও হয়ত অশোক ঘোষ নন। কিন্তু সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টাটুকু অন্তত করতেন। পেটোয়া বা কন্ট্রাক্টর পরিবৃত হয়ে থাকতেন না। নিজের চোখ, কান খোলা রাখতেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। তাঁদের অন্তত রাজনৈতিক সদিচ্ছাটুকু ছিল, বামপন্থী মনোভাব ও চেতনাটুকু ছিল, কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানসিকতাটুকু ছিল। ‌

naren chatterjee3

কী কী হতে পারে?‌ দলকে নতুন করে উজ্জীবিত করবেন?‌ যেখানে তিনি ঢুকবেন, পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। যাঁরা এই অসময়েও দলের সম্পদ হতে পারতেন, তাঁদের অপমান ও হেনস্থা করবেন। অহেতুক গায়ে গা পেড়ে সিপিএমের সঙ্গে ঝগড়া করবেন। নিজেকে বিরাট বিপ্লবী জাহির করবেন। এভাবেই তৃণমূলের কাছে নিজের নম্বর বাড়াবেন। আসলে, তৃণমূলে যাওয়ার পথ প্রশস্থ করবেন। এতদিন কোনও কোনও নেতা বা কর্মী নাম লিখিয়েছেন। এবার সরাসরি রাজ্য সম্পাদক যদি চলে যান, অবাক হওয়ার কিছু নেই। একটি বামপন্থী দলের রাজ্য সম্পাদক সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মূল্যায়ন করা হয়ত উচিত নয়। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসযোগতা এতটাই তলানিতে যে এমন আশঙ্কাটাই সবার আগে উঠে আসে।

ফ ব নেতারা নরেন চ্যাটার্জিকে চিনতেন না?‌ তাহলে খাল কেটে এমন মানুষটিকে কেন ডেকে আনলেন?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.