সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
তিন বছর বয়সে বাড়ির টেপরেকর্ডারে প্রথম শুনেছিলাম, ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’। গানটার কথা, সুর এবং কে গাইছেন এসব কিছুই তখন জানতাম না। কিন্তু কেমন একটা আচ্ছন্নের মতো গানটা শুনতাম। আর কেন জানি না বারবার শুনে এত লম্বা গানটা মুখস্থ হয়েও গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়িই। তার বেশ কয়েক বছর পরে আস্তে আস্তে জেনেছিলাম গীতিকার, সুরকার এবং সেই জলদমন্দ্র কণ্ঠের অধিকারীর নাম। তারপরে ‘গাঁয়ের বঁধু’, ‘পাল্কির গান’, ‘অবাক পৃথিবী’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে কেমন মিশে গিয়েছিলাম শ্রদ্ধা, ভাল লাগা, প্রেম, ভালবাসা, পাগলামি থেকে ও রেকর্ড সংগ্রহের নেশায়। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে ‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি’ বা ‘পথে এবার নামো সাথী’ শুনে একটা অন্য ধরণের ভাবালুতা কেমন যেন গ্রাস করে ফেলত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এইভাবেই অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর শ্রদ্ধার্ঘ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আধুনিক ও ছায়াছবির গানের পাশাপাশি হয়ে উঠেছিলেন গণসঙ্গীতেরও এক সার্থক কণ্ঠশিল্পী।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পরে এক তরুণ কবি ও গীতিকার তখন লুকিয়ে আর পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য তিনি। নিজের লেখা কয়েকটা গীতিকবিতায় সুরারোপ করলেও সেভাবে তখনও পরিচিত হননি। না গীতিকার হিসেবে, না সুরকার হিসেবে। মূলতঃ প্রতিবাদের গান লেখা এবং তাতে সুর দেওয়াই তাঁর প্রধান কর্মধারা। একদিন সেই তরুণ এসেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তাঁর লেখা কতগুলো গান শোনাতে। সেটা ১৯৪৯ সাল। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাংলা আধুনিক গানে একটু পরিচিতি লাভ করলেও বাংলা গানে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিল্পীরা কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজ মল্লিক এবং শচীন দেববর্মণ। সেই নবাগত তরুণ গীতিকারের প্রায় সবকটি গানই তরুণ হেমন্তর মনঃপূত না হওয়ায় ফিরে যাচ্ছিলেন ভগ্নমনোরথ সেই তরুণ। হঠাৎ কী মনে হল, মাঝপথে আবার ফিরে এলেন। হেমন্তকে শোনালেন তাঁর অর্ধেক রচিত একটি গান। সোল্লাসে মেতে উঠেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই গান শুনে। সেদিনের সেই তরুণ সলিলকে বললেন, পুরো গানটা লিখে নিয়ে আসতে। তারপরই বাংলা আধুনিক গানের জগতে সৃষ্টি হয়েছিল সেই কালজয়ী গান, ‘কোনো এক গাঁয়ের বঁধুর কথা তোমায় শোনাই’।
আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরে সেদিনের সেই তরুণ সলিল চৌধুরি তাঁর পরম অগ্রজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’র মতো একের পর এক শোষিত মানুষের জীবনকাহিনীর গীতিকবিতা। অচিরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্যপদ পেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তখন সলিল–হেমন্ত যুগলবন্দী মানেই ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন দর্শনের একের পর এক সুপারহিট গান। কোথাও ঝড়ের মুখে প্রেমের ছোঁয়ার মতো ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’ বা ‘শোনো কোন একদিন, আকাশ–বাতাশ জুড়ে রিমঝিম’ বা কোথাও আবার ‘মনের জানালা খুলে উকি দিয়ে গেছ’, ’আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ র মতো প্রেম বা বিরহের গান। তার পরে এসেছিল সেই অবিস্মরণীয় মুক্তিসংগ্রামের গান ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জলদমন্দ্র কণ্ঠস্বরে এই গণসঙ্গীত বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল বিপ্লবের বার্তা নিয়ে।
এখানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মুনশিয়ানা। তিনি একাধারে বাংলা ছায়াছবির গানের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে মধ্যগগনের সূর্যের মতোই দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন। আর হিন্দি ছায়াছবিতেও ‘নাগিন’ মুক্তির পরে আসমুদ্রহিমাচল তাঁর সুরের স্পর্শে আবিষ্ট হয়েছিল, যা পাঁচের দশক থেকে সাতের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অমলিন ছিল। ভারতীয় সঙ্গীতের এই দুই মূল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। বাংলা ছবিতে উত্তম কুমারের কণ্ঠ যেমন তিনিই, তেমনি উত্তম কুমার ব্যতিরেকে সৌমিত্র, বিশ্বজিৎ, অনিল চট্টোপাধ্যায়-প্রমুখের নেপথ্যেও পরিচালকদের পছন্দের তালিকায় তিনিই। আবার হিন্দি ছবিতেও প্রদীপ কুমার, দেব আনন্দ প্রমুখের নেপথ্যেও হেমন্তই বিরাজিত। তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার থেকে মান্না দে, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা দত্তদের কণ্ঠে একের পর এক কালজয়ী সব গান তৈরি হয়েছিল। বাংলার হেমন্ত সেদিন হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী এবং সুরকার।
এ হেন প্রশ্ন থেকে যায়, যাঁর কণ্ঠে ‘রানার’, ‘গাঁয়ের বঁধু’, ‘অবাক পৃথিবী’ বা ‘ঠিকানা’ বাংলার শহরে, গ্রামে, আকাশে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল ঝড়ের হাওয়ার মতো, তিনি যদি শুধুমাত্র গণসঙ্গীতেই মনোনিবেশ করতেন, তাহলে হয়তো IPTA ছেড়ে বম্বে পাড়ি দিতেন না রত্নলাভের আশায়। গণসঙ্গীতের জগতে তখন সলিল চৌধুরি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা প্রমুখের ভারতজোড়া খ্যাতি। সেখানে পাকাপাকিভাবে চিরস্থায়ী আসন লাভ করা কি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পক্ষে কঠিন কাজ ছিল ?
আসলে ঘটনাটা হল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কোনওদিনই সঙ্গীতের একটি মাত্র শাখায় নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। তাঁর প্রথাগত সাঙ্গীতিক শিক্ষা হয়তো খুব বেশি ছিল না, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক রাগ–রাগিনী তে যে তিনি পারঙ্গম ছিলেন না, একথা নিজের মুখেই নির্দ্বিধায় স্বীকার করে গিয়েছিলেন। তবুও তাঁর ছিল এক আশ্চর্য রকমের সাঙ্গীতিক বোধশক্তি, ছায়াছবির দৃশ্য বা ঘটনার গতিপ্রকৃতি অনু্যায়ী ব্যবহৃত গানের সুরারোপ করার এক অতুলনীয় দক্ষতা, যা তাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম সারির কণ্ঠশিল্পী থেকে বাংলা ও হিন্দি ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের রূপদান করেছিল। বাংলায় রবীন্দ্রগান থেকে নজরুল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদের গান বা বেসিক গান, হিন্দিতে ছায়াছবির গান ছাড়াও গীত বা গজল এবং ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষা যেমন মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া, ভোজপুরি, কোঙ্কনী—সবেতেই তিনি তাঁর ছোঁয়া রেখে যেতে পেরেছিলেন। গণসঙ্গীতের যে দীপ তিনি জ্বেলে দিয়েছিলেন সলিল চৌধুরির হাত ধরে, তা বস্তুত অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও বাংলার সহস্র সঙ্গীতপ্রেমীর ঘরে ঘরে আজও বেজে চলেছে রেকর্ডে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। সলিল চৌধুরির সুরারোপ ছাড়াও সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের সুরেই রেকর্ড করেছিলেন ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’ এবং বাংলার দুর্জয় জনতা’ এর মতো দুটি অনবদ্য গান, যা ভারতীয় গণসঙ্গীতের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরার তালিকায় থাকতে বাধ্য।
গজল সম্রাট মেহেদি হাসান হেমন্ত কণ্ঠকে এই উপমহাদেশের ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল মহাসাগর পেরিয়ে সুদূর আমেরিকাতেও। প্রখ্যাত মার্কিন পরিচালক কনরাড রুকস এর ‘সিদ্ধার্থ’ ছায়াছবির-(১৯৭২) সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যা তাঁকে প্রথম ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মার্কিন নাগরিকত্বের সম্মান দান করেছিল। সলিল চৌধুরি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর যদি নিজের কণ্ঠে গান গাইতে পারতেন তো তাঁর গলা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠের মতোই শোনাতো’। লতা মঙ্গেশকরের কথায়, ‘হেমন্তদার কণ্ঠ শুনলে মনে হত কোনো সাধু বা সন্ন্যাসী মন্দিরে নিবিষ্ট চিত্তে ভজন গাইছেন’। আর হেমন্তের পরম সুহৃদ এবং পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘হেমন্তকালের বিকেলে রোদ পড়ে আসা পল্লীগ্রামের বাড়ির নিকোনো উঠোনে গোলা ভরা ধানের মতোই আমাদের হেমন্তের ছিল গলা ভরা গান’!
রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি, কৌতূহল ভরে’, তেমনি আজ সবার অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও হয়তো তাঁর জন্মশতবর্ষে বলছেন, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে/পান্থ পাখীর কূজন কাকলি ঘিরে/আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো/আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’।