যত দোষ দিলীপ ঘোষ!‌

মন কী বাত

সরল বিশ্বাস

কতকাল আগে থেকে একটা কথা শুনে আসছি, যত দোষ, নন্দ ঘোষ। এখন বোধ হয় প্রবাদটা বদলে দেওয়া যেতে পারে। বলা যেতেই পারে, যত দোষ, দিলীপ ঘোষ।

হঠাৎ করেই শুনলাম, আমাকে নাকি সেন্সর করা হয়েছে। আমি নাকি মুখ খুলতে পারব না। আমি নাকি টিভি চ্যানেলে কোনও কথা বলতে পারব না। আমি কথা বললে দল নাকি বিড়ম্বনায় পড়ছে। এতে নাকি দলের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। এসব শুনিয়ে আমার কাছেই কিনা প্রতিক্রিয়া চাওয়া হচ্ছে।

আমাকে নাকি চিঠি লেখা হল। আমি সেই চিঠি পেলাম না। অথচ, তার আগেই দেশ দুনিয়া জেনে গেল। কেন আমার মুখ বন্ধ করা হল, তা নিয়ে অন্যরা মুখ খুলতে শুরু করে দিল। সন্ধেবেলায় যথারীতি চণ্ডীমণ্ডপও বসে গেল। সেই চিঠি এর তার মোবাইলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই সেই চিঠি পড়ে ফেলল। শুধু আমারই পড়া হয়নি।

এতদিন শুনতাম, আমার কথা শুনে তৃণমূল রেগে যেত। এখন আমার দলের লোকেরাই রেগে যাচ্ছে। অথচ, কথাগুলো কি খুব ভুল বলেছি?‌ গত কয়েকদিনে কী এমন বলেছি?‌ ১)‌ যারা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গেল, তারা কেউ আমার হাত ধরে বিজেপিতে আসেনি। যাদের হাত ধরে এসেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন। ২)‌ যারা দিল্লিতে গিয়ে যোগদান করেছেন, তাদের দিল্লির জল হজম হচ্ছে না। ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছে। ৩)‌ কেন তারা তৃণমূলে ফিরে গেল, সেটা পরে ভাবা যাবে। কেন তারা এসেছিল, কেন তাদের নেওয়া হয়েছিল, এখন সেটাই আগে ভাবতে হবে। ৪)‌ শুধু সিবিআই হলেই হবে না। তদন্তের রেজাল্ট চাই। নইলে মানুষের আস্থা থাকবে না।

এর মধ্যে কোনটা ভুল?‌ আসলে, দিল্লির নেতারা বুঝেছেন, তাঁদের চালাকিটা আমরা ধরে ফেলেছি। এবার সত্যিই এত খারাপ ফল হত না। লোকসভায় আমরা ১৮ খানা আসন পেয়েছিলাম। আরও দু’‌খানা অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়েছে। বিধানসভায় আমরা আসছিই, মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। না, আমাদের বিরাট কোনও সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। মূলত বাম ভোটের বড় একটা অংশ আমাদের দিকে এসেছিল। মোদ্দা কথা, যারা তৃণমূলকে পছন্দ করে না, তারা আমাদের ওপর ভরসা রেখেছিল। কিন্তু আমরাই পারিনি সেই ভরসার যোগ্য হয়ে উঠতে।

তৃণমূলের অনেকেই দেওয়াল লিখনটা পড়তে পেরেছিলেন। তাঁরাও বুঝেছিলেন, বিজেপি আসছে। তাই এইদিকে ভিড়েছিলেন। ‌আমাদের দিল্লির নেতারাও বোধ হয় তেমনটাই চেয়েছিলেন। তাঁদের কাছেও তো ইন্টালিজেন্স রিপোর্ট থাকে। তাঁরা জানতেন, তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখার একটাই উপায়। দলটা তৃণমূলের ছাঁটমালদের এনে বোঝাই কর। এইসব লোককে জামাই আদর করে এনে যদি টিকিট দাও, তাহলে এরা কিছুতেই জিতবে না। এদের ভোট দেওয়ার থেকে মানুষ বরং তৃণমূলকেই দেবে। কারণ, এলাকায় এইসব লোকের যা ইমেজ, তাতে এদের ভোট পাওয়ার কথা নয়।

মোদ্দা কথা, দিল্লির নেতারা চাননি এখান থেকে তৃণমূল সরে যাক। কেন চাননি, সে তাঁদের সমীকরণ। তাঁরা চেয়েছিলেন, কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা যেন একজোট না হতে পারে। সেই কারণে কয়েকটা আঞ্চলিক দলকে অক্সিজেন দিতে হবে। সেই তালিকায় তৃণমূলও আছে। মোদ্দা কথা, তৃণমূল যদি এখানে হেরে যায়, তাহলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সামনে কংগ্রেসের দিকে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। কিন্তু তৃণমূল যদি এখানে টিকে যায়, তাদের উচ্চাকাঙ্খা আরও বেড়ে যাবে। দিদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভিন্ন রাজ্যে প্রার্থী দেবেন। তাতে কংগ্রেসেরই ভোট কাটবে। আখেরে লাভ হবে বিজেপির। অসম বো গোয়ায় দেখেছেন। ত্রিপুরাতেও দেখবেন। এটাই ছিল ফর্মুলা। সেইসঙ্গে অন্যান্য কয়েকটা আঞ্চলিক দলকেও কংগ্রেসের কাছাকাছি যেতে দেবেন না। তাই তৃণমূলকে একটু অক্সিজেন দিয়ে টিকিয়ে রাখা। সেই কারণে সিবিআই–‌ইডি লোকদেখানো তদন্ত করে। কাজের কাজ কিছুই করে না। নইলে তৃণমূলের বেলুন কবে চুপসে যেত।

কিন্তু এবার কোনওভাবেই তৃণমূলকে টিকিয়ে রাখা যেত না। মানুষের ঘৃণা এতটাই তীব্র ছিল, যে কোনও উপায়ে তাঁরা তৃণমূলকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাহলে উপায়!‌ উপায় একটাই। তৃণমূল থেকে ভুসি মালদের আনো। তাদের টিকিট দাও। যেন তাদের ওপর রাগ করে মানুষ বিজেপিকে ভোট না দেয়। অথচ বিজেপি যদি এইসব লোকেদের প্রার্থী না করত, অনায়াসে জিতে যেত। সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিল্লির নেতারা চলেন তাঁদের নিজেদের হিসেবে। সব বুঝি। কিন্তু দলের বাইরে তো আর এসব বলতে পারি না। তাই এতদিন আমি আমার মতো করে কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করে গেছি।

আসলে, নীচের তলার কর্মীরাও দিল্লির এই চালাকিটা ধরে ফেলেছিলেন। তৃণমূল থেকে সাময়িক রাগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও বুঝেছিলেন, দিল্লি কখনই চায় না এই রাজ্যের সরকারকে সরাতে। বুঝতে পেরে তাঁরাও কেটে পড়েছেন। বামেদের যে অংশটা আমাদের দিকে এসেছিল, তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন, এই বিজেপি আর যাই হোক তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করার মঞ্চ নয়। কেন তদন্ত থেমে যায়, কেন সিবিআই ঘুমিয়ে থাকে, এটা এখন জলের মতো পরিষ্কার।

এতদিন বলিনি। বুঝতে পেরেও চেপে গিয়েছিলাম। তাই এতদিন দিল্লি সেন্সর করার কথা ভাবেনি। আচ্ছা বলুন তো, অর্জুন সিং কেন তৃণমূলে ফিরে গেল, আমি কী করে বলব?‌ আমি কি তাঁকে দলে এনেছিলাম?‌ যাঁরা এনেছিলেন, তাঁরা জবাব দিন। যাঁরা চার্টার্ড ফ্লাইটে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দলবদলুদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ কোথায়?‌ সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। সিবিআই শুনেই আমাদের কর্মীদের কেউ কেউ আনন্দে লাফায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, এতে উল্লাস দেখানোর কিছু নেই। ঠিক সময় সিবিআই আবার ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের কাজ কিচ্ছু করে না। কোন সমীকরণে ঘুমিয়ে পড়ে, একটা বাচ্চা ছেলেও আজ বোঝে। তাই বলেছিলাম, শুধু তদন্ত হলে হবে না। রেজাল্ট চাই। কী জানি, আরও হয়ত গোপন কথা ফাঁস করে ফেলতাম।

এবার বোঝা গেল, আমার মুখ বন্ধ করার এত তোড়জোড় কেন?‌

(‌বিধিসম্মত সতর্কীকরণ:‌ এটা মোটেই দিলীপ ঘোষের লেখা নয়। কোনও সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটা বলেনওনি। নিছকই মন কী বাত। মুখ বন্ধ থাকলে মন একটু বেশি কথা বলে। হয়ত মনে মনে তিনি এমনটাই বলছেন।)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.