ছেলেরা এতদিন অনলাইনে কী পড়েছে, অভিভাবকরা এবার বুঝলেন তো?‌

অভয় সরকার

আমার জন্ম সাতের দশকে হলেও তখন নিতান্তই শৈশব। কিছু বুঝে ওঠার মতো বয়স হয়নি। সাতের দশক সম্পর্কে যা শুনেছি, তা বড় হওয়ার পর। শুনেছি, তখন নাকি গণ টোকাটুকি চলত। কলেজের বেঞ্জে ছুরি আটকে রেখে কেউ কেউ পরীক্ষা দিত। দেখে দেখে উত্তর লেখা হত। এমনকী যিনি গার্ড দিচ্ছেন, তাঁকেও নাকি উত্তর বলে দিতে হত। হয়ত কিছুটা সত্যি, কিছুটা অতিরঞ্জিত।

কিন্তু এই ২০২২ সালে এসেও এমন আজগুবি আবদার শুনতে পাব, সত্যিই ভাবিনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে পড়ুয়ারা মিছিল করছে, বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তা দেখে সেই সাতের দশকের কথাই মনে পড়ছে। এও তো সেই গণ টোকাটুকির থেকেও মারাত্মক দাবি। ভাবতে অবাক লাগে, ছাত্রদের বিরাট একটা অংশ এরকম একটা আজগুবি আবদার করে কী করে?‌ এই দাবিতে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্না, ঘেরাও চলছে!‌ সত্যিই, শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, এই মিছিলগুলোই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

এটা ঘটনা, করোনার কারণে গত দু’‌বছর পড়াশোনা স্বাভাবিক গতিতে চলেনি। অনেক স্কুল, কলেজে অনলাইন ক্লাস করতে হয়েছে। পড়ুয়ারা সারাক্ষণ মগ্ন সেই স্মার্টফোনে। বাড়ির অভিভাবকদের তারা বুঝিয়ে এসেছে, তারা অনলাইনে পড়াশোনা করছে। বাবা–‌মাও দিব্যি ফলাও করে অন্যদের শুনিয়ে এসেছেন, তাঁদের ছেলে নাকি অনলাইনে পড়াশোনা করছে। ছেলে যে কী পড়েছে, এবার বেশ ভাল বোঝা যাচ্ছে।

বইয়ের সঙ্গে এমনিতেই বিরাট একটা অংশের তরুণ–‌যুবকের সম্পর্ক কমে এসেছে। সারাক্ষণ সবাই স্মার্ট ফোনেই মুখ গুঁজে আছে। বাবা–‌মা বারণ করতে গেলে শুনিয়ে দিয়েছে, এসব অনলাইন পড়াশোনা, তোমরা বুঝবে না। কিছুটা হীনমন্যতায়, কিছুটা বাধ্য হয়ে বাবা–‌মাও অনেক সময় মেনে নিয়েছেন। কিন্তু যেই পরীক্ষা হাজির, অমনি কঙ্কালটা বেরিয়ে এসেছে। এখন দাবি, কিছুতেই পরীক্ষা দেব না। অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হবে।

অথচ, গত এক দেড় বছরে কোনওকিছুই থেমে নেই। দিব্যি সবাই পুজোয় ভিড় করেছে, রাস্তায় বেরিয়েছে, বেড়াতে গেছে। কিন্তু যত আপত্তি সেই পরীক্ষার বেলায়। তখনই নাকি করোনা হয়ে যাবে। অথচ, পরীক্ষা দেব না, এই মিছিল কিন্তু হচ্ছে বিরাট জমায়েত সহযোগে। অধিকাংশের মুখেই মাস্কের কোনও বালাই নেই। তখন করোনা হচ্ছে না। যত করোনা, শুধু পরীক্ষার সময়। একটা সহজ বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না, পড়াশোনা যদি নাই হয়ে থাকে, তাহলে অনলাইন পরীক্ষার দাবিই বা উঠছে কেন?‌ আসলে, দাবিটা সেই বাড়ি থেকে পরীক্ষা দেওয়ার। যেখানে বাইরে থেকে হোয়াটস অ্যাপে উত্তর চলে আসবে। কপি পেস্ট করে দিলেই হয়ে যাবে। অনেকের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে সামনে বই দিলেও লিখতে পারবে না। কারণ, বইয়ের কোন জায়গায় উত্তরটা লেখা আছে, সেটাও খুঁজে পাবে না। এমনকী ঠিকঠাক বাক্যগঠনটুকুও অনেকে করতে পারে না।

ভাবতে অবাক লাগে, শাসক দলের ছাত্র সংগঠন এই দাবিতে তোলপাড় করছে। বাকি ছাত্র সংগঠনগুলিও কার্যত এরকম দাবি মেনে নিচ্ছে। উপাচার্যের ঘরের দরজায় লাথি মারছে স্নাতকোত্তরের ছাত্ররা। শিক্ষকরাও কার্যত অসহায়। এমন আজগুবি দাবি মানা সম্ভব নয়, এই সামান্য কথাটুকুও সরকার বলতে পারছে না। আলোচনা করছি, বিবেচনা করছি বলে অনর্থক ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। এতে সেই জুলুমবাজিকেই আরও বেশি করে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না তো?‌ এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই অন্যায় আবদার। বিনা ভোটে ছাত্র সংসদ দখল করে সবজায়গায় সেই দখলদারির মানসিকতা এসে যাচ্ছে। তাই ছাত্রদের এমন অদ্ভুত আবদার শুনেও সরকারকে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে হচ্ছে।

এই ছাত্ররাও বুঝছে না তারা নিজেদের কী ক্ষতি ডেকে আনছে। এইভাবে অনলাইনে ভুরি ভুরি নম্বর পেলেও সেই নম্বরের যে কোনও মূল্য থাকবে না, এই সহজ সত্যিটাও তারা বুঝছে না। পঞ্চাশ বছর পরেও সাতের দশকের সেই গণ টোকাটুকির কথা ওঠে। তাদের সেই ডিগ্রির পেছনেও সেই ‘‌অনলাইন’‌ কলঙ্ক থেকে যাবে। সরকারেরও উচিত, এইভাবে সময় নষ্ট না করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা। নইলে, এই অদ্ভুত দাবি দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.