এই হার্দিককে কি আপনি চিনতেন!‌

ঋষভ সোম

আইপিএল তাঁর কাছে নতুন নয়। সেই ২০১৫ থেকে খেলছেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের জার্সি গায়ে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোট পাঁচবার। তার মধ্যে শেষ চারবার দলে ছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। এই চারবারই বড় ভূমিকা পালন করেছেন বরোদার এই অলরাউন্ডার। কিন্তু এবারের আইপিএল যেন চিনিয়ে দিয়ে গেল অন্য এক হার্দিক পান্ডিয়া। এই আইপিএল যেন তাঁর শাপমুক্তির আইপিএল।

মাস ছয়েক আগের কথা। সদ্য টি২০ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে ভারত। প্রথম দুটো ম্যাচ হারের ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেননি বিরাট কোহলিরা। তাই পরের তিনটে ম্যাচ জেতার পরেও কিছু লাভ হয়নি। শুরু থেকেই ছিল প্রত্যাশা। ভারত জিততে চলেছে। এমন নাছোড়বান্দা প্রত্যাশার পর যদি প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যায়, গেল গেল রব ওঠাই স্বাভাবিক। সেটাই উঠেছিল। কেন এমন লজ্জাজনক বিদায়, তার ময়না তদন্ত চলেছিল গণমাধ্যম, সমাজমাধ্যমে। সবথেকে বড় ভিলেন হিসেবে উঠেছিল একটাই নাম— হার্দিক পান্ডিয়া।

মনে হবে, হার্দিক ছাড়া বাকিরা বোধ হয় দারুণ সফল। একা হার্দিক খেলতে পারলেন না বলেই বোধ হয় ভারতের এই শোচনীয় ফল। চার্জশিট মোটামুটি তৈরিই ছিল ১)‌ কেন চোট লুকিয়ে খেলেছেন?‌ ২)‌ তিনি যে বোলিং করতে পারবেন না, এটা কেন নির্বাচকদের জানাননি?‌ ৩)‌ ব্যাট হাতেই বা রান নেই কেন?‌ ৪)‌ বল করতেই যদি না পারেন, তাহলে দলের সঙ্গে বয়ে বেড়ানো কেন?‌ তাহলে কীসের অলরাউন্ডার?‌ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরসঙ্গে যুক্ত হল পুরনো নানা অনুষঙ্গ। এই ছেলের সঙ্গে কিনা কপিলদেবের তুলনা! আইপিএল খেলেই ছেলেটা উচ্ছন্নে গেল।‌ সোশ্যাল মিডিয়ায় বউকে নিয়ে খুব ছবি দেওয়ার ধুম। আবার টিভিতে মেয়েদের নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা!‌ আবার হাতে উল্কি আঁকা!‌ দেখতে না পারলে যা হয়!‌ চলন বাঁকা। হার্দিকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ক্রিকেটীয় সমালোচনার থেকেও জমে থাকা অক্রিকেটীয় রাগের বহিপ্রকাশ। আচ্ছা, কেউ যদি কপিলের সঙ্গে হার্দিকের তুলনা করেও বসেন, এতে হার্দিকের দোষটা কোথায়!‌ তিনি তো আর বলেননি যে আমি কপিলদেবের থেকে বড় অলরাউন্ডার। তাহলে, অন্যের ভুলভাল প্রশংসার খেসারত তাঁকে কেন দিতে হবে!‌

কিন্তু দিতে হয়েছিল। সমালোচনার ঝড় বয়েছিল। নীরবে রিহ্যাব করে গেছেন। এই কয়েক মাসে যতটা সম্ভব মৌন থেকেছেন। আইপিএলের আসরে নতুন দল এল গুজরাট টাইটান্স। স্বাভাবিকভাবেই ঘরের ছেলেকেই অধিনায়ক করা হল। তখনও ভেসে এসেছিল নানা ব্যাঁকাট্যারা মন্তব্য। এই বাউন্ডুলে ছেলে কিনা ক্যাপ্টেন! আর দেখতে হচ্ছে না। এই টিমের রসাতলে যাওয়া কে ঠেকাবে!‌ ‌

পুরনো কথাগুলো একঝলক মনে করিয়ে দেওয়া। অনেক সমালোচনাই হয়ত সঙ্গতও ছিল। হয়ত অনেকটাই হার্দিকের প্রাপ্যও ছিল। কিন্তু মাত্র একটা আইপিএল যেন অনেকটাই বদলে দিয়েছে সেই বিতর্কিত ক্রিকেটারকে। এই আইপিএলের আবিষ্কার কারা, তা নিয়ে অনেক তরুণ ক্রিকেটারের নাম ভেসে আসছে। কেন, হার্দিক পান্ডিয়াও কি এবারের আইপিএলের আবিষ্কার নন!‌ বদলে যাওয়া এই হার্দিককে কি আপনি সত্যিই চিনতেন!‌

দল নির্বাচন থেকে শুরু। নিলামে কাদের নেওয়া হবে, সে ব্যাপারেও ছিল পরিণত বুদ্ধির ছাপ। শুরু থেকেই যে দলটা সবথেকে ধারাবাহিক, তার নাম গুজরাট টাইটান্স। শুরু থেকেই শীর্ষে, অন্তত তিন ম্যাচ আগে থেকেই এসে যায় প্লে অফের ছাড়পত্র। ইডেনের প্লে অফ, আর আমেদাবাদের ফাইনালেও অনায়াস জয়। একেবারেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া বলতে যা বোঝায়, সেটাই করে দেখিয়েছেন হার্দিক। পরের দিকে ব্যাট করেও করেছেন ৪৮৭ রান। রয়েছেন প্রথম চারজনের মধ্যে। শুরুর দিকে ব্যাট করলে এই রান হয়ত সাড়ে ছশো ছাপিয়ে যেত। দুরন্ত ফিল্ডিং তো ছিলই। সমালোচনা বেশি হচ্ছিল বোলার হার্দিককে ঘিরে। অন্য কেউ হলে শুরু থেকেই জেদের বশে বেশি বোলিং করার পথে হাঁটতেন। কিন্তু সংযম দেখিয়েছেন অধিনায়ক হার্দিক। আস্তে আস্তে নিজেকে ছন্দে এনেছেন বোলার হার্দিক। আসল স্পেলটা যেন তুলে রেখেছিলেন ফাইনালের জন্য। প্রথম তিন ওভারে মাত্র সাত রান দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন মূল্যবান তিনটি উইকেট। চার ওভারে সেটা দাঁড়াল ৩/‌১৭। ফাইনালের সেরার তকমাটা যেন যথার্থই পোয়েটিক জাস্টিস। যেন সম্পূর্ণ হল একটা বৃত্ত।

ব্যাট হাতে কত রান করেছেন, বল হাতে কটা উইকেট নিয়েছেন, এই পরিসংখ্যানগুলো না হয় লেখা থাকে। কিন্তু অনেক টুকটো টুকরো বিষয় আছে যেগুলো স্কোর বোর্ডে বা স্ট্যাটিস্টিক্সে ধরা পড়ে না। জাতীয় দল ও আইপিএল নিলামে ব্রাত্য থাকা একটা শান্ত ছেলে ঋদ্ধিমান সাহার বুকের ভেতরের আগুনটাকে কীভাবে উস্কে দিতে হয়, সেই ভূমিকাটা আড়ালেই থেকে যাবে। শুরুতে সেই ঋদ্ধিকে পাঠিয়ে সুপার ওভারে ঝড় তোলানোর ঝুঁকিটা খুব সহজ ছিল না। শেষের দিকে ঝড় তোলার জন্য মিলারকে মজুত রাখাও মুন্সিয়ানার পরিচয়। সামির মতো ধারালো অস্ত্রকে কীভাবে আরও শান দিতে হয়, পাশাপাশি নবীন প্রতিভাদের কীভাবে তুলে ধরতে হয়, বেশ বুদ্ধিত্তার সঙ্গেই দেখিয়েছেন। রশিদের মতো লেগস্পিনারের হাতে শেষদিকে বল তুলে দিতে হিম্মৎ লাগে বইকি। মাঝে একবার ছন্দপতনও ঘটেছিল। টানা দুই ম্যাচে হারতে হয়েছিল। যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলে, তখন অনেক ভুল চাপা পড়ে যায়। কিন্তু যখন একবার ছন্দপতন হতে শুরু করে, তখন কিন্তু অনেক ত্রুটি বেআব্রু হয়ে পড়ে। সেই সময়টায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জেও দিব্যি উতরে গেছেন অধিনায়ক হার্দিক।

কখন চেনা ছকে এগোতে হয়, কখন ছক বদল করে ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটতে হয়, অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কখন তারুণ্যের মিশেল দিতে হয়, প্রতিটা বাঁকে যেন ছাপ রেখে গেছেন। তাই যে ছেলেটাকে কয়েকমাস আগেও বাউন্ডুলে মনে হত, সেই ছেলেটাকেই হঠাৎ করে কেমন যেন বিচক্ষণ ও দায়িত্বশীল মনে হচ্ছে। সত্যিই, একটা আইপিএল একটা বাউন্ডুলের মধ্যে কী অদ্ভুত রূপান্তর এনে দিল।

 

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.