তিনি আচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি ঠেকায় কে!‌

ওপেন ফোরাম

রক্তিম মিত্র

তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন। নিজেই পরীক্ষা দেন। নিজেই খাতা দেখেন। নিজেই রেজাল্ট ঘোষণা করেন। তারপর নিজেই নিজেকে সংবর্ধনা দেন। কোনও কাজই অন্যের জন্য ছেড়ে রাখেন না। এমন স্বনির্ভর মুখ্যমন্ত্রী ভূভারতে সত্যিই বিরল।

এবার তাঁর ইচ্ছে হয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হবেন। সরাসরি তাঁর ইচ্ছে হয়েছে, বলা কেমন যেন অশোভনীয় শোনায়। আসলে, তিনি এমন অনুগত পারিষদ তৈরি করেছেন, যাঁরা তাঁর মনের হদিশ রাখেন। তাঁরা জানন, কোনটায় তিনি খুশি হন। কোনটা তিনি চান কিন্তু মুখে বলতে পারছেন না।

আচ্ছা, মন্ত্রীসভার বৈঠকে একজন মন্ত্রী ইচ্ছেমতো প্রস্তাব আনতে পারেন!‌ বিশেষ করে এই জমানায়!‌ সব দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একজনই ঘোষণা করেন। মন্ত্রীর নির্বাক দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। শিক্ষা থেকে সেচ, কৃষি থেকে শিল্প। পশুপালন থেকে পর্যটন। বেচারা মন্ত্রীরা সত্যিই বড় অসহায়। টিভির ব্রেকিং নিউজে মিডিয়া আগে জানে, সেখান থেকে দর্শক জানেন। তারপর বেচারা মন্ত্রীর কানে পৌঁছয়।

এক্ষেত্রে মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রস্তাব আনা হল, এবার থেকে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখ্যমন্ত্রীই আচার্য হবেন। ব্যাস, একজন প্রস্তাব তুলে দিলেই হল। কার ঘাড়ে কটা মাথা যে অন্য কথা বলবেন!‌ বাধা একজনই দিতে পারতেন। একজনই বলতে পারতেন, না, আমি হতে চাই না। কিন্তু তিনি বলেননি। আর তিনি যখন বাধা দেননি, তখন সর্বসম্মত হতে আর বাধা কোথায়?‌

মন্ত্রীমশাই ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করে জানালেন, বিষয়টি মন্ত্রীসভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। যেন বিরাট এক গর্বের ব্যাপার। এই ‘‌সর্বসম্মতি’‌র মধ্যে যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও আছেন, এটা অন্তত পরিষ্কার করলেন শিক্ষামন্ত্রী। দিন কয়েক আগের কথা। এই শিক্ষামন্ত্রীই ঘোষণা করেছিলেন, নিরলস সাহিত্য সাধনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলা আকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এটাও সরাসরি মঞ্চেই ঘোষণা। যথারীতি পারিষদরা ধন্য ধন্য রব তুলতে লাগলেন। এবারও তাই হল। স্বাগত জানানো ছাড়া আর উপায় কী?‌

২০১৬ থেকে ২১, ব্রাত্য বসু কোন দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন?‌ একটা সমীক্ষা হয়ে যাক। খোদ তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের মধ্যেই সমীক্ষা হোক। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আশি শতাংশ ভুল উত্তর দেবেন। যাক, সেখান থেকে অন্তত ফের শিক্ষায় উত্তরণ ঘটেছে। এটুকুর জন্য কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতেই পারেন। তারই ফলশ্রুতি ওই বাংলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার। তারই ফলশ্রুতি এই আচার্য ভূষণ।

সারা ভারতে না হয় নাই বা নজির থাকল। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী না হয় নজির গড়লেন। সত্যিই তো মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হলে অসুবিধা কোথায়?‌ এতদিন উপাচার্য বাছাইয়ে কত ঝামেলা, কত জটিলতা। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন কর। কী কী যোগ্য থাকতে হবে, তা নির্ণয় কর। শাসকদল কোনটা চাইছে, সেই সমীকরণ বুঝে তিনটে নাম প্রস্তাব করো। তারপর সেই নাম রাজ্যপালের সইয়ের জন্য আটকে থাকবে। তারপরেও ‘‌তিনি’‌ রেগে যেতে পারেন। লম্বা একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যদি আচার্য হন, এতকিছুর সমস্যাও থাকবে না। কীসের নিয়ম?‌ কীসের মাপকাঠি?‌ তাঁর যাঁকে করতে ইচ্ছে হবে, তাঁকেই ভিসি করতে পারেন। তিনি যেটা করবেন, সেটাই আইন। যদি মনে হয় সোনালি গুহ বা আরাবুল ইসলামকে কিছু দেওয়া দরকার, হয়ত দলীয় মঞ্চ থেকেই ঘোষণা করে দেবেন, ‘‌কাল থেকে তুই উপাচার্য হবি।’ যাঁকে হয়ত লোকসভায় টিকিট দেওয়া গেল না, দিলেন তাঁকে উপাচার্য বা আচার্য মনোনীত প্রতিনিধি করে। আর ‌তালে তাল দিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীরা তো আছেনই। মোদ্দা কথা, পেটোয়া পুনর্বাসনের একটা জায়গা হয়ে গেল।

আর প্রশাসনিক বৈঠক থেকেই উপাচার্যকে নির্দেশ দেবেন, ওখানে তো অনেকটা জায়গা আছে। বাঁ দিকটায় ম্যানগ্রোভ লাগাবি। ‌ইউনিভার্সিটি থেকে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড বিলি হবে। ক্যাম্পাস জুড়ে থাকবে তাঁর বড় বড় কাট আউট। একেক ইউনিভার্সিটির সিলেবাস একেকরকম। ইচ্ছে হলে, সবমিলিয়ে দিতে পারেন। আর তাঁকে খুশি করার জন্য তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ দিব্যি ঢুকে যেতে পারে সিলেবাসে। এমনকী প্রশ্নও আসবে সেখান থেকেই। যেন পড়ুয়ারা ওই বিষয়গুলো পড়তে বাধ্য হয়।

মোদ্দা কথা, ভাল কিছুর আশা করা সত্যিই বড় কঠিন। মন এতখানি আশাবাদী হতে সায় দেয় না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.