এই পথে এক একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ

সন্তু বিশ্বাস
যাওয়ার আগে শুনেছিলাম। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ট্রেন যেই ঘাটশিলা পেরোলো, বুঝলাম সত্যিই পাহাড় দিয়ে ঘেরা। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই পাহাড়। কিন্তু দুদিন থাকার পর মনে হল, পাহাড় দিয়ে ঘেরা সত্যিই, কিন্তু পাহাড় কোথায় ? যত এগোই, ততই সরে সরে যায়। ঠির মরীচিকার মতো।
ঘাটশিলার পরের স্টেশন গালুডি। এমনিতে জায়গাটার তেমন নামডাক নেই। থাকার কথাও নয়। গালুডিতে এমন কিছুই নেই, যা আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। এমন কিছুই নেই, যা একবার দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবেন বা বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে। তবু কোলাহল থেকে দূরে, দুটো দিন যদি অন্যরকমভাবে কাটাতে চান, গালুডির টিকিট কাটতেই পারেন। ভূগোলের সীমানায় এটা ঝাড়খণ্ড। কিন্ত ভিনরাজ্যে আছেন, একবারও মনে হবে না। নিশ্চিত করে বলা যায়, কলকাতার কোনও প্রান্তেই এত বাংলা কথা শুনতে পাবেন না। একেবারে বাঙালি উপনিবেশ বলতে যা বোঝায়, তাই।

galudih5

এই গালুডির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা। পরপর দুদিন সেখানে হেঁটে গেলাম। নে পড়ে গেল মান্না দে-র সেই গানের লাইনটা, ‘হায় রে স্রোতস্বিনী, এমন শীর্ণা তোরে দেখিনি তো আর কোনওদিন।’ এই নদীকে ‘শীর্ণা স্রোতস্বিনী’ও বলা যাবে না। একেবারে মজে যাওয়া একটা নদী বলাই ভাল। এর নাম সুবর্ণরেখা। এই নদীর পাড়ে, এই নদীর নামে সিনেমা বানিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক ? মোহভঙ্গ হতে বাধ্য। অথচ, একসময় কী উত্তাল চেহারা ছিল এই সুবর্ণরেখার! গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে যেত। নদীর গতিকে আটকে তার ঘাড় ধরে বিদ্যুৎ আদায়ের জন্য কত জায়গায় বাঁধ হয়েছে। কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ হবে জানি না। কত একর জমি সেচের জল পাবে, তাও জানি না। শুধু বুঝলাম, একটি নদীর অপমৃত্যু হয়েছে। তবে ঘোর বর্ষায়, বাঁধের গেট খুলে দিলে নাকি আবার উত্তাল হয়ে যায় নদী। মাস খানেক পর কাগজেও তাই দেখলাম। কিন্তু সেই সময় বড় কষ্টই হয়েছিল সুবর্ণরেখাকে দেখে।
ফেরার পথে একটি চায়ের দোকান। অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই। সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা। আরেকটু আসতেই গ্রামের হাট। মনে পড়ে গেল, ‘হাট বসেছে শুক্রবারে, বক্সিগঞ্জের পদ্মাপারে’। এমন কত দৃশ্যকল্প তৈরি হয়ে গেল মনে মনে।

স্টেশনটাও ভারী সুন্দর। একেবারেই প্রান্তিক একটা স্টেশন। কোনও চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই। নির্জনতায় মোড়া। সন্ধেবেলায় এই স্টেশনের নির্জন বেঞ্চ আপনাকে অন্য এক পৃথিবীর সন্ধান দেবে। মাঝে মাঝে একটা ট্রেন বা মালগাড়ি সেই নিস্তব্ধতায় কিছটা ছন্দপতন ঘটাবে।

galudih2 (1)

থাকার জায়গা খুব যে আহামরি, এমন নয়। ‘নেই’ এর তালিকা দীর্ঘ। তখন গাইতে পারেন, ‘যেটা ছিল না ছিল না সেটা না পাওয়াই থাক, সব পেলে নষ্ট জীবন।’ স্টেশনের একেবারে লাগোয়া মারোয়াড়ি ধর্মশালা। মাথাপিছু ভাড়া মাত্র পঞ্চাশ টাকা। সবাই দরজা খুলেই এখান ওখান দিব্যি ঘুরে আসছে। কী আশ্চর্য, কোনওদিন নাকি কারও কোনও জিনিস চুরি হয়নি। কেয়ারটেকার অনায়াসে বলতে পারেন, ‘দরজা খুলে যেখানে খুশি যেতে পারেন, কেউ কোনও জিনিসে হাত দেবে না।’ আমাদের এখানে বাসে বা অন্যত্র অহরহ দেখি, ‘মালের দায়িত্ব আরোহীর’। প্রতিবেশী রাজ্যে অন্তত দায় এড়ানো স্লোগানটা নেই। বরং হাসিমুখে দায় নেওয়ার সংস্কৃতিটাই বেশি চোখে পড়ল।
আশেপাশে ঘোরার জায়গা অনেক আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা যেদিন গেলাম, পরের দিন মাওবাদীদের বনধ। কোনও অটো কোথাও যেতে রাজি হল না। এখানে পাহাড় আর জঙ্গল একসাথে। বুঝলাম, পাহাড় বা জঙ্গল, কেউ হাসছে না। এবং জনজীবনে মাওবাদীদের প্রভাবটা নিছক অতীত নয়, থমথমে বর্তমান।
বাঁদিকে আধঘণ্টা গেলে দুয়ারসিনি। হ্যাঁ, পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ানের সেই দুয়ারসিনি, যেখানে মাওবাদীরা বনবাংলো উড়িয়ে দিয়েছিল। কী আর করা যাবে, এই পরিচয়েই এখন দুয়ারসিনির পরিচিতি। অথচ, পাহাড় আর জঙ্গলঘেরা কী অনাবিল সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে এই দুয়ারসিনি জুড়ে। বসন্তে দিগন্তজুড়ে লাল পলাশ ফুল।

galudih2

দুয়ারসিনির উল্টোদিকে গেলে পাবেন ঘাটশিলা। হ্যাঁ, বিভূতিভূষণের স্মৃতিবিজড়িত ঘাটশিলা। এখানেই দীর্ঘদিন ছিলেন পথের পাঁচালির স্রষ্টা। সেই বাড়িটা আজও আছে। সংস্কারও হয়েছে। সামনের রাস্তাটার নাম দেওয়া হয়েছে অপুর পথ। নিশ্চিন্দিপুর নয়, মনে হবে অপু দুর্গা এই পথেই ক্ষেতের আল ধরে ছুটত, কাশবন পেরিয়ে ট্রেন দেখতে যেত।

একটু দূরেই ফুলডুংরি। ছোট্ট টিলা। তেমন বিশেষত্ব কিছু নেই। তবে ভাল লাগবে। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে অটোতে উঠে যান। এ তল্লাটের সেরা আকর্ষণ নিঃসন্দেহে বুরুডি লেক। এত পাহাড়ের উপর এই জলাশয় কীভাবে তৈরি হল, সে বিস্ময় থেকেই যাবে। চাইলে বোটিং করা যায়। নাই বা হলেন তেনজিং নোরগে। লেকের পাশের ছোট্ট টিলায় উঠে মনে করতে পারেন, এভারেস্ট জয় করলেন। যতক্ষণ বসে থাকবেন, ভালই লাগবে।
সময় থাকলে যেতে পারেন ধারাগিরি। অটো থেকে নেমে অনেকটা হাঁটতে হবে। জঙ্গলের রাস্তা মাড়িয়ে সেই অকৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণা। সেই নির্জনতায় একটু গা ছমছম করতে পারে। অনেকটা হাঁটার পর সেই অনুভূতিটাও মন্দ লাগবে না।
সবমিলিয়ে তাহলে কী দাঁড়াল? অনেক কিছুই নেই। তবু দু’চোখ ভরে প্রকৃতিকে দেখুন। মজে যাওয়া নদী দেখে হয়ত মন খারাপ হবে। কিন্তু সেই নদীও যে আপনাকে অনেককিছু বলতে চায়!

(আপনি কোথাও ঘুরে এলেন ? নিজের অনুভূতির কথা মেলে ধরতে চান ? তাহলে আপনার অনুভূতির কথা লিখে পাঠান বেঙ্গল টাইমসে। সঙ্গে ছবিও পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.