মুকুলের ছায়া থেকে এখনও নিস্তার নেই কুশলের

সোনার কেল্লার সেই মুকুল। আজকের কুশল চক্রবর্তী। মাঝে পেরিয়ে গেছে ৪৬ বছর। সত্যজিৎ রায়কে ঘিরে টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি। বলে গেলেন কুশল। লিখলেন স্বরূপ গোস্বামী ।।

দেখতে দেখতে ৪৬ বছর হয়ে গেল সোনার কেল্লার। একটা ছবি। গোটা জীবনটাকেই আমূল বদলে দিল। দেখতে দেখতে আমার বয়সও ৫৪ পেরিয়ে গেল। কত রকম ছবি করলাম। কত ছবির পরিচালনা করলাম। টিভির দুনিয়াতেও প্রায় তিন দশক কেটে গেল। অথচ, এখনও আমি সেই মুকুল। এখনও কেউ কেউ ওই নামেই ডেকে ওঠে। আসলে, কুশল চক্রবর্তী মানেই মুকুল, এটাই অনেকে মনে রাখতে চায়। আমিও কি ভুলতে পেরেছি সোনার কেল্লার ওই টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো!

কীভাবে যোগাযোগ ?
সোনার কেল্লা যখন মুক্তি পায়, আমার বয়স তখন মাত্র ছ’বছর। ওই বয়সে কে সত্যজিৎ রায়, কে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এসব বোঝার কথা নয়। অভিনয়ে নামব, এমন ভাবনাও আসার কথা নয়। আসলে, আমার অভিনয় কিছুটা হঠাৎ করেই। আরও দু’বছর পিছিয়ে যাই। আমার বয়স তখন মাত্র চার বছর। নিজের মনেই নানারকম ছবি আঁকতাম। বাবা সেগুলোকে এখান ওখানে পাঠাতেন। একবার একটা পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হল। সেই ছবিটা দেখে মানিক জেঠুর ভাল লাগে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম মানিক জেঠুর বাড়িতে। সেই শুরু। তার বছর দুই পর মানিক জেঠু বাবাকে একটা চিঠি লিখলেন। জানান, তিনি সোনার কেল্লা ছবি করতে চান। আমাকে মুকুলের চরিত্রে ভেবেছেন।

sonar kella

প্রোডিউসার পাওয়া যাচ্ছিল না!
তিনি তো ভাবলেন। আমি মুকুলের রোল করব, মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু নতুন এক বিভ্রাট। কারণ, ছবির প্রোডিউসার পাওয়া যাচ্ছিল না। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক সোনার কেল্লা করবেন, অথচ প্রোডিউসার পাচ্ছেন না, ভাবা যায় ! কিন্তু এমনটাই হয়েছিল। কারণ ? নায়িকা নেই, গান নেই। এমন ছবিতে কে আর টাকা ঢালতে চায়? অথচ, সত্যজিৎ রায় যে তখন আনকোরা পরিচালক ছিলেন, এমনও নয়। কারণ, তার প্রায় কুড়ি বছর আগে পথের পাঁচালি বেরিয়ে গেছে। প্রোডিউসার যখন নেই, তখন কী আর করা যাবে! আমরা তখন বিরাটিতে থাকতাম। বাড়িতে টেলিফোনও ছিল না। মানিক জেঠু বাবাকে চিঠি লিখলেন। জানালেন, আমার প্রোডিউসার পালিয়েছে। গান আর নায়িকা বর্জিত ছবিতে টাকা দিতে চায়নি। যদি হয়, পরে জানাব।
ইউনিট যেন পরিবার
ছবির কাজ তো শুরু হয়ে গেল। দেড় মাসের আউটডোর। তাও আবার রাজস্থানে। ছ বছরের একটা ছেলের পক্ষে এতদিন বাড়ির বাইরে থাকা কতখানি কষ্টকর, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। বাবা অবশ্য সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে জানি না, ইউনিটের সবার সঙ্গেই দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। সবাই আমাকে খুব ভালবাসতেন। সবমিলিয়ে আমরা একটা পরিবার হয়ে উঠলাম। দিল্লি থেকে জয়পুর। সেখান থেকে যোধপুর, বিকানির, জয়সলমির। তখন খুব ঠান্ডা। যাওয়ার আগে আমার জন্য দুটো পুল ওভার বোনা হয়েছিল। একটা বুনেছিল মা। আরেকটা জেঠিমা (মানিক জেঠুর স্ত্রী, বিজয়া রায়)। আমার জন্য যে লাল রঙের পুল ওভারটা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটা বেশ টাইট। মনে আছে, জেঠিমা সেটাকে আবার খুলে ওপর দিকটা নতুন করে বুনলেন। গলাটা আলগা করে দিলেন। আমরা যখন সোনার কেল্লা করতে গিয়েছিলাম, তখন জয়সলমিরে মাত্র একটা হোটেল ছিল। ফলে, যাওয়ার সময় আমরা বস্তায় করে চাল, ডাল, সব নিয়ে গিয়েছিলাম।

দাবায় মানিক জেঠুকে হারিয়েছিলাম।
আমি বলতাম, মানিক জেঠু। তিনি সবাইকে সব ব্যাপারে জ্ঞান দিচ্ছেন। আবার আমার সঙ্গে যখন কথা বলছেন, তখন একেবারে আমার ভাষায়। খুব সহজ করে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। উনি যে কত বড় পরিচালক, তা বোঝার মতো বয়স বা বুদ্ধি, কোনওটাই আমার ছিল না। তবু কেন জানি না, মানুষটাকে বেশ ভাল লাগত। আমি দাবা খেলতে ভালবাসতাম। উনিও আমার সঙ্গে দাবা খেলতে বসে যেতেন। তাঁর যতই বুদ্ধি থাক, তিনি ভাল দাবা খেলতে পারতেন না। এমনকি আমার কাছেও মাঝে মাঝে হেরে যেতেন। মানিকজেঠুকে হারিয়ে আমি খুব আনন্দ করতাম। ব্যাপারটা বাবার ভাল লাগেনি। বাবা আমাকে ওভাবে আনন্দ করতে বারণ করলেন। তখন মানিকজেঠু বাবাকে বললেন, ও বাচ্চা ছেলে। একটু আনন্দ করছে। করুক না, ওকে বারণ করছ কেন ?
প্রশ্নের সন্ত্রাস
লোকেশানে যাওয়ার আগে আমি মানিকজেঠুর পাশে বসতাম। আমার মনে তখন কতরকম প্রশ্ন। যাকে কাছে পাচ্ছি, তাকেই প্রশ্নবানে জর্জরিত করে দিচ্ছি। কখনও সৌমিত্রকাকুকে, কখনও সন্তোষ জেঠুকে, কখনও কামু জেঠুকে। কখনও জানতে চাইছি, রাতে তারা দেখা যায় কেন ? কখনও বলছি, সপ্তর্ষিমণ্ডল কোনটা, কখনও জিজ্ঞেস করছি, সূর্যটা কেন পাহাড়ে ঢেকে আছে? সৌমিত্রকাকু বলছেন, পরে বলব বাবা। অন্যরাও দেখি, এড়িয়ে যাচ্ছেন। ভয়ে ভয়ে থাকছেন, কখন কী প্রশ্ন করে বসি। কিন্তু একজন লোক কখনও বিরক্ত হননি, মানিকজেঠু। ঠান্ডা মাথায় আমার একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলেন। কখনও বিজ্ঞানের সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে, আবার কখনও ইতিহাস থেকে নানা গল্প টেনে এনে সহজভাবে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এখন যখন ভাবি, অবাক হয়ে যাই। এত বড় মাপের মানুষ এত সহজে মিশতে পারেন! যাঁরা বাইরে থেকে মানিকজেঠুকে গম্ভীর ভাবেন, তাঁরা তাঁকে কতটা ভুল জানেন, সেটাই মাঝে মাঝে ভাবি!

৬ মাস পর কান্না
আমরা জয়সলমির থেকে ফিরে গেছি। ছ মাস পেরিয়ে গেছে। কলকাতায় তখন ফাইনাল এডিটিং চলছে। হঠাৎ মানিকজেঠুর মনে হল, একটা কান্নার দৃশ্য ঢোকালে ভাল হয়। সোনার কেল্লায় দাঁড়িয়ে মুকুল কাঁদছে। সেই কান্না আস্তে আস্তে হাসিতে বদলে যাবে। হাসির দৃশ্যটা ওখানে শুট করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে একটা কান্নার দৃশ্য জরুরি ছিল। মানিকজেঠু ডেকে পাঠালেন। আমাকে বললেন, একটা কান্নার দৃশ্য ঢোকাতে হবে। জানতে চাইলেন, আমি পারব কিনা। কিন্তু কলকাতায় সোনার কেল্লা কোথায় পাওয়া যাবে? মানিকজেঠু বললেন, তুমি যদি কাঁদতে পারো, আমি এখানে নতুন করে সেট তৈরি করব। কুড়ি হাজার টাকা খরচ। তুমি কাঁদতে পারলে তবেই কুড়ি হাজার টাকার নকল সেট তৈরি করব।’ কুড়ি হাজার টাকা মানে ঠিক কতটা, তখন বুঝিনি। তবে আমার জন্য কলকাতায় নকল সেট তৈরি হবে! এটা ভাবতেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। নকল সেট তৈরি হল। ছমাস পর সেই কান্নার দৃশ্য শুট করা হল। যদি খুব খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলে কান্না আর হাসির দৃশ্যের তফাতটা বুঝতে পারবেন। কারণ, কান্নার দৃশ্যে আমার নতুন দাঁত বেরিয়েছে। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে কুড়ি হাজার টাকা মানে বেশ বড়সড় অঙ্ক। শুধুমাত্র একটা কান্নার দৃশ্য নেবেন বলে তিনি কলকাতায় একটা নকল সোনার কেল্লা বানিয়েছিলেন, তাও আবার এক শিশু শিল্পীর জন্য! কতখানি পারফেকশনিস্ট হলে এমনটা করা যায়!

মাস্টার নয়
সিনেমায় ছোটদের অভিনয় নতুন কিছু ন‌য়। আমার থেকেও কম বয়সে অনেকে অভিয় করেছে। সেই শিশুকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করেও ছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই দেখেছি, সেই শিশুশিল্পীর নামের আগে ‘মাস্টার’ কথাটা লেখা থাকে। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু টাইটেল কার্ডে ‘মাস্টার কুশল’ লেখা ছিল না। লেখা হয়েছিল পুরো নাম—কুশল চক্রবর্তী। ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে মামুলি একটা ব্যাপার। কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনা থেকে বোঝা যায়, একজন শিশুশিল্পীকে তিনি কতখানি মর্যাদা দিতেন। অন্য পরিচালকদের মতো তিনি ‘‌মাস্টার’‌ প্রথায় বিশ্বাস করেননি। তাই আমার গায়ে কখনও ‘মাস্টার’ তকমাটা লাগেনি।

sonar kelala3
তাঁর চিঠিতেই স্কুলে
সোনার কেল্লা মুক্তি পেল শুক্রবার। শনিবার থেকে আমি যেন সেলিব্রিটি। কত লোক এসে নিজে থেকে কথা বলছে। কেউ হাত মেলাচ্ছে, কেউ সই চাইছে। কেউ গাল টিপে দিচ্ছে। অনেকে জানতে চাইছে, কোন স্কুলে পড়ি। আমি উত্তর দিচ্ছি, পড়ি না। কারণ, সত্যিই আমি তখনও পর্যন্ত কোনও স্কুলে ভর্তিই হইনি। লোকে ভাবল, ছেলেটা আগে বোধ হয় স্কুলে যেত। ফিল্মে নেমে বখে গেছে। পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। আমার এসব অভিজ্ঞতার কথা বাবা একদিন মানিকজেঠুকে বললেন। মানিকজেঠু পাঠভবন স্কুলে একটা চিঠি লিখে দিলেন। ভর্তি হয়ে গেলাম। হ্যাঁ, আমার স্কুলে ভর্তির পেছনেও মানিকজেঠু।

চাকরি ছেড়ে অভিনয়ে
একে একে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোলাম। আর কোনও ছবিতে অভিনয় করিনি। বা, অভিনয়কে পেশা করার কথাও ভাবিনি। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে সুযোগ পেয়ে ভর্তি হলাম যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। পাঁচ বছর পর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারও হয়ে গেলাম। পাস করতে না করতেই চাকরিও পেয়ে গেলাম। চাকরি নিয়ে চলে গেলাম গুজরাটে। দিব্যি চাকরি করছিলাম। কিন্তু কেন জানি না, ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কলকাতায় ফিরে যাই। ফিরে এলাম। শুধু ফিরে আসা নয়, মাথার মধ্যে আবার অভিনয়ের পোকাটা নড়ে গেল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসকে নিয়ে জোছন দস্তিদার একটা মেগা ধারাবাহিক করতে চাইলেন। গঙ্গা-র চরিত্রে সুযোগ পেলাম আমি। ফিরে আসার পর ওটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট। আর পেছন ফিরে নয়। একেবারে পুরোপুরি জড়িয়ে গেলাম অভিনয়ের সঙ্গে।

এই তো কালকের ঘটনা!
সোনার কেল্লার মুকুল নাকি জাতিস্মর ছিল। আগের জন্মের কথা তার মনে পড়ে যেত। আমার পূর্বজন্ম আমি জানি না। কিন্তু বারবার সোনার কেল্লার কথা মনে পড়ে যায়। এত বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন মাত্র ছয়। ভুলে যাওয়ারই কথা। হয়ত ভুলেও যেতাম। কিন্তু নানা জায়গায় এতবার আমাকে ‘সোনার কেল্লা’র গল্প বলতে হয়েছে, মনে হয়, এই তো কালকের ঘটনা। যতদিন বাঁচব, আরও কতবার যে বলতে হবে! বিশ্বাস করুন, একটুও বিরক্তি আসে না। মনে মনে আমিও যে ফিরে যাই ওই সোনার কেল্লায়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.