বর্ণালী শিকদার
বাংলা সাহিত্যে যেমন গোয়েন্দার অভাব নেই, তেমনি সিনেমাতেও অভাব নেই। তবে তাদের সঙ্গে একেনবাবুর একটা ফারাক আছে। এতদিন পর্যন্ত আগে গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়েছে। তারপর সেখান থেকে সিনেমা হয়েছে। একেনবাবুর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। এখানে আগে সিনেমা হয়। তারপর সেখান থেকে গল্প লেখা হয়।
আরও একটা বড় ফারাক আছে। অন্যান্য গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দাকে বুদ্ধিমান মনে হয়, তুলনায় সহকারীকে কিছুটা বোকা মনে হয়। সহকারীরা হয় ভুলভাল সন্দেহ করেন, নয় কমিক রিলিফ দিয়ে যান। এক্ষেত্রে একেনবাবু নিজেই যেন কমিক রিলিফ দিয়ে যান। তুলনায় সঙ্গীদের বেশ বুদ্ধিমান–বিচক্ষণ মনে হয়। একেনবাবুকে দেখে মনে হয়, চারিদিকে ঘেঁটে ঘ করে বসে আছেন। তাঁকে নিয়ে অন্যরা মস্করা করে। তিনি রাগেন না। বরং বেশ উপভোগ করেন। শেষবেলায় দেখা যায়, আপাতভাবে বোকা ও সরল এই মানুষটি তলে তলে সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেছেন। যদিও শেষমেশ কৃতিত্বটা অন্যদের দিয়েই আনন্দ পান।
এতদিন একেনবাবু ধরা দিচ্ছিলেন ওয়েব সিরিজে। এবার তিনি এলেন বড় পর্দায়। আর বড় পর্দায় আসতে গেলে একটা বড়সড় ক্যানভাস লাগে। দার্জিলিং ছাড়া আবির্ভাবের মঞ্চ আর কীই বা হতে পারত! অনেক গোয়েন্দা গল্পেই দেখা যায়, তিনি নিছক বেড়াতেই গেছেন। তারপর কোনও না কোনও তদন্তে জড়িয়ে যান। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে, অনেকটা সেইরকম। এক্ষেত্রেও একেনবাবু, মানে একেন্দ্র সেন গিয়েছিলেন নির্ভেজাল বেড়াতে। কিন্তু জড়িয়ে গেলেন প্রথমে চুরি, সেখান থেকে খুনের তদন্তে।
গোয়েন্দা গল্পের বা সিনেমার আরও একটা কমন মিল আছে। তিনি যেখানেই যান, সবাই তাঁকে চিনে ফেলেন। অর্থাৎ, তিনিও একটা সেলিব্রিটি। এখানেও তাই। সবে দার্জিলিং ম্যালে পা রেখেছেন, অমনি তাঁকে দেখে চিনে ফেললেন এক জনপ্রিয় নায়িকা। ম্যালে থাকতে থাকতেই ফোন চলে এল এসপি–র। পরে সটান তিনি হোটেলে হাজির। এসপি–র আর্জি, নায়িকা নাকি একেনবাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অর্থাৎ, একেনবাবুকে যেতে হবে সেই নায়িকার কাছে।
প্রথমে দেওয়া হল একটা ছবি খোঁজার ভার। তদন্ত শুরু হতে না হতেই এসে গেল হোটেলকর্মী খুনের কিনারার দায়িত্ব। ওদিকে, শোনা যাচ্ছে, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে এক অধ্যাপকের খুন হওয়ার কাহিনী। দার্জিলিংয়ের হোটেলকর্মীর খুনের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের অধ্যাপক খুনের কীই বা সম্পর্ক? কখনও সেই বিষ্ণুমূর্তি, কখনও রহস্যজনক খাম। নানা দিকে মোড় নিচ্ছে তদন্ত, সেই সঙ্গে জন্ম নিচ্ছে নিত্যনতুন জট। একটা জট ছাড়ে তো অন্য জট এসে যায়।
এভাবেই শেষমেষ কিনারা। গোয়েন্দা গল্পের আসল চমক হল শেষটা। যেখানে গোয়েন্দা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এক এক করে খোলসা করেন। তখনই জটগুলো একটা একটা করি পরিষ্কার হয়। এখানে সেটাই হল ধাপে ধাপে। তবে এতগুলো জট ছাড়াতে গিয়ে কোথাও কোথাও গোঁজামিল রয়েছে। কোথাও আবার অহেতুক জটিলতাও তৈরি হয়েছে। দার্জিলিংয়ে যখন শুটিং, তখন গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরা দার্জিলিংয়ের আঁকেবাঁকে একটু ঘুরপাক খাবে, এটাও প্রত্যাশিত। সেই জায়গায় যেন ঘাটতি থেকে গেল। একেনবাবুর যা চরিত্র, তাতে রুদ্ধশ্বাস গতিতে তাড়া করা, বন্দুক নিয়ে মারপিট করা–এগুলো নিতান্তই বেমানান। কিন্তু পরিচালক অহেতুক সাসপেন্স আনার জন্য কেন যে এসব দৃশ্য আনতে গেলেন! এগুলো না থাকলে ছবিটা আরও বুদ্ধিদীপ্ত হতে পারত।
দুই সফরসঙ্গী মাঝে মাঝেই লেগপুলিং করে চিত্রনাট্যকে প্রাণবন্ত রেখেছেন। টাইটেল সং একটা ছিল ঠিকই, তবে ওয়েব সিরিজের টাইটেল সংটা বেশ পরিচিত। সেটাও রাখা যেত। বাদবাকি গানের তেমন দরকার ছিল না। একঝলক কেভেন্টার্স, একঝলক গ্লেনারিজের বাইরেও দার্জিলিংয়ের পরতে পরতে অনেক ইতিহাস। কায়দা করে সেগুলোকে একটু ছোঁয়া যেত। এতে অন্তত দার্জিলিংয়ের সেই ফ্লেভারটা থাকত।
সবমিলিয়ে বড় পর্দায় একেনবাবুর যাত্রা শুরুটা মন্দ নয়। একেবারে অন্য ঘরানার এই গোয়েন্দা চরিত্রকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।