রক্তিম মিত্র
করোনার তখন সেই শুরু। এই রোগের লক্ষণ কী? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায় সব ডাক্তারই বলছিলেন, দম বন্ধ হয়ে আসে। ২০২১ এর শুরুতেই বাংলা রাজনীতিতে যেন সেই লক্ষণটা দেখা দিল। রোজই শোনা যাচ্ছে, কারও না কারও দম বন্ধ হয়ে আসছে। তৃণমূলে নাকি আর থাকা যায় না। ওটা নাকি পিসি–ভাইপো প্রাইভেট লিমিটেড। দলে দলে বিজেপিতে নাম লেখানোর হিড়িক। সেখানে নাকি মুক্ত বাতাস আছে। সেখানে নাকি ‘মানুষের জন্য কাজ করার’ প্রচুর সুযোগ আছে।
সারা বছর শীতঘুম দিলেও ভোট মরশুম এলেই কেউ কেউ ‘মানুষের জন্য কাজ’ করতে উতলা হয়ে পড়েন। সেই কাজ করতে কোনও না কোনও একটা পতাকা ধরে ফেলেন। গদগদ হয়ে নিজেকে সমাজসেবী জাহির করতে একেবারে উঠেপড়ে লাগেন। টিকিট না পেলেই বা ভোটে হেরে গেলেই সেই কাজ করার ইচ্ছে কর্পুরের মতো কোথায় যে উবে যায়! বছরের মাঝপথ থেকে সেটাই হল। যাঁরা ঘটা করে পদ্মশিবিরে তরী ভিড়িয়েছিলেন, জুন মাস থেকেই তাঁদের দ্বিতীয় দফার দম বন্ধ শুরু হয়ে গেল। করোনা থমকে গেলেও তাঁদের কোয়ারেন্টিন দশা থামল না। তারপর অঙ্ক কষে একে একে একটু বেসুরো গাওয়া। পাল্টা দম বন্ধের ফিরিস্তি শোনানো। বিজেপিতে থেকে কাজ করা যায় না, এটা বোঝানো। তারপর চিত্রনাট্য অনুযায়ী যা হওয়ার কথা! তৃণমূলের দরজায় ইট তো পাতাই ছিল। একটু দরজা ফাঁক হলেই দন্ত বিগলিত করে আবার ঢুকে পড়া।
মোদ্দা কথা, এই একটা বছরে যে দলবদলু প্রভাব দেখা গেল, তা স্বাধীনতার পর থেকে আর কোনও বছর দেখা যায়নি। টুকটাক দলবদল প্রতিবছরই হয়। কিন্তু এবার যেন ‘দম বন্ধ’ হওয়ার প্রবণতাটা একটু বেশিই ছিল। গত লোকসভা ভোটের পর থেকেই হাওয়া বুঝে বেসুরো গাওয়ার একটা মরশুম শুরু হয়েছিল। কে এগিয়ে, কারা আসবে, দাড়িপাল্লায় অনেক জল মাপার চেষ্টা হয়েছে। কেউ একটু একটু করে গেরুয়া হয়েছেন। কেউ হঠাৎ করে ঝাঁপ মেরেছেন। আবার কেউ দু’পা এগিয়েও শেষবেলায় পিছিয়ে গেছেন।
ফেলে আসা বছরের শুরুতেই ছিল সবথেকে মেগা দলবদল। ১২ জানুয়ারি, বিবেকানন্দের জন্মদিনে একঝাঁকে অনেকেই যোগ দিলেন বিজেপির মঞ্চে। একসঙ্গে এতজনের যোগদান তার আগেও হয়নি। তার পরেও আর হয়নি। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দফায় দফায় চলেছে এই দলবদল। যাঁরা এতদিন উন্নয়নের জোয়ার ছাড়া কিছুই বুঝতেন না, তাঁদের অনেকেই নৌকো থেকে লাফ মারতে উদ্যমী। এমনই অবস্থা, অর্ধেকের বেশি আসনে বিজেপি প্রার্থী করল সেই দলবদলুদেরই। অধিকাংশই তৃণমূল থেকে আসা। কেউ কেউ বাম বা কং শিবির থেকে। আবার কেউ কেউ তথাকথিত গ্ল্যামার জগৎ থেকে।
দিল্লির বিজেপি নেতৃত্ব ভেবে নিলেন, গো বলয়ে যেমন আয়ারাম–গয়ারাম চলে, বাংলাতেও বোধ হয় তেমনটাই চলবে। অন্য দল ভাঙিয়ে আনলেই তাঁরা বোধ হয় ড্যাং ড্যাং করে জিতে যাবেন। এতদিন যিনি এলাকায় তৃণমূল নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এতদিন যিনি সিন্ডিকেট থেকে কাটমানি সাম্রাজ্য চালিয়ে গেছেন, পঞ্চায়েতে যিনি ভোট লুঠ করেছিলেন, তাঁরা যদি হঠাৎ করে বিজেপির জার্সি গায়ে খেলতে নেমে পড়েন, মানুষ এতই বোকা যে পিলপিল করে তাঁকে ভোট দেবেন! ফলে, লোকসভাতেও যে প্রবল তৃণমূল বিরোধী হাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, তা অনেকটাই প্রশমিত হয়ে গেল। বিজেপিতে দ্রুত মোহভঙ্গ ঘটতে লাগল। ফল যা হওয়ার, তাই হল। নির্বাচনে কার্যত ধরাশায়ী হতে হল বিজেপিকে। কেউ কেউ সাতাত্তর আসন পাওয়াকে বিরাট জয় দেখাতেই পারেন। কিন্তু এটা যে আসলে চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান, সেটা বিজেপি নেতৃত্ব এখনও ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারেননি।
ঝাঁকের কই একে একে ঝাঁকে ফিরছে। সেই দলবদলুরা এতদিনে বুঝে গেছেন, বিজেপিতে থেকে আর লাভ নেই। তাই তৃণমূল শিবিরে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রেখেছেন। ডাকিলেই যাইব। না ডাকিলেও দরজায় ধাক্কা মারিব। গাইতে শুরু করেছেন, ‘তুমি না রাখিলে গৃহ আর পাইব কোথায়? কেঁদে কেঁদে কোথা বেড়াব?’ তৃণমূলও দরজা খোলার ক্ষেত্রে একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম নিয়ম রেখেছে। কাউকে পতাকা তুলে দেওয়া হচ্ছে বিধানসভার মাঝে। কাউকে ভাঙিয়ে এনে করে দেওয়া হল পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। কেউ আবার যোগ দিলেন ত্রিপুরায় গিয়ে। তাঁকে বলা হয়েছে, আপাতত এলাকায় ফিরবে না। ত্রিপুরাতেই পড়ে থাকো। বিধানসভার স্পিকার মশাইও যথারীতি আগের ফর্মে। আগেও দলবদলুদের বাঁচানোর জন্য যেমন নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে গেছেন, এখনও সেই ট্রাডিশন বজায় রেখেছেন। মুকুল রায় বিজেপির টিকিটে জিতে তৃণমূলে নাম লেখালেও মাসের পর মাস তাঁকে সময় দিয়েই চলেছেন। অন্যান্য আরও হাফ ডজন বিধায়কের ক্ষেত্রেও এই লুকোচুরি চলছে।
দলবদলুরা চিরকাল ছিলেন। আগামীদিনেও থাকবেন। কিন্তু সাংবিধানিক পদে থাকা স্পিকার মশাই যদি দার্শনিক নীরবতার আশ্রয় নেন, নানা রকম টালবাহানা করে যান, সেটা আরও বেশি নিন্দনীয়। দলবদলুরা জানেন, এমন দলভাঙানো মুখ্যমন্ত্রী বা এমন বধির স্পিকার থাকলে তাঁদের কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবে না। আইন তাঁদের ছুঁতেও পারবে না। ফেলে আসা বছরে কোনও আশার আলো কি দেখা গেল? জোরালো উত্তর, না।