সেদিন হঠাৎ করেই ফোন করল পরিমলদা। পরিমলদা মানে, রাজাভাতখাওয়ার পরিমল বর্মন। টুকটাক কিছু কথার পরই জানালেন, আশ্রমের সেই সাধুবাবা নাকি মারা গেছেন।
সাধুবাবার নাম কী, জানি না। দু একবার জানার চেষ্টা করেছিলাম। উনি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলেন। পরিমলদাও জানে না। ওই এলাকায় সবাই তাঁকে সাধুবাবা বলেই জানতেন।
রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী যাওয়ার পথ। দু পাশে ঘন জঙ্গল। এদিক থেকে হাতি চলে যায় এদিকে। ওদিক থেকে চিতাবাঘ অনায়াসে রাস্তা পেরিয়ে চলে আসে এদিকে। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাতেও কেমন একটা গা ছমছম করে। হেঁটে ওই রাস্তায় চলাই বারণ।
চেকপোস্ট পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার গেলেই ডানদিকে চোখে পড়বে একটা ওয়াচ টাওয়ার। তার ঠিক গায়েই একটা ছোট্ট ঘর, কুয়ো। ওই ঘরটাই সাধুবাবার মন্দির কাম আশ্রম। ওখানেই তিনি একাই থাকতেন। রাতে বিরেতে হাতি আসত, চিতাবাঘ আসত। কিন্তু সাধুবাবুর কোনও ভয়ডর নেই। উনি ওই বারান্দাতেই দিব্যি শুয়ে থাকতেন।
ওই রাস্তা দিয়ে যাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তাঁরা প্রায় সবাই সাধুবাবাকে চেনেন। অনেকেই আসা যাওয়ার পথে দাঁড়ান। কেউ সাধুবাবার সঙ্গে দেখা করে যান। কেউ মন্দিরে মাথা ঠেকিয়ে যান। এমনকি ফরেস্ট গার্ডরাও জঙ্গলে টহল দিতে ঢোকার আগে সাধুবাবাকে নমস্কার করে যান।
এখানে যে হাতির দল আসে, তার অজস্র নমুনা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। ওয়াচ টাওয়ারের দেওয়ালে হাতিরা পিঠ চুলকোয়। সেই দাগ দেওয়ালজুড়ে রয়ে গেছে। হাতির পায়ের ছাপ, পটি এসব তো আছেই। চিৎকার করে যখন হাতির দল আসে, সাধুবাবা লোকজনকে বলতেন, যাও তোমরা ওয়াচ টাওয়ারে উঠে যাও। যা দেখার ওপর থেকে দেখো। ওদের জ্বালাতন করবে না।
উপর থেকে পর্যটকরা দেখতেন, হাতি গুলো আসত। সাধুবাবা তাদের শুঁড়ে হাতি বুলিয়ে দিতেন। হাতিরাও সেই আদর, সেই স্নেহ দিব্যি উপভোগ করত। তারপর আবার মাটির রাস্তা ধরে জঙ্গলে চলে যেত। দুর্বল, শীর্ণকায় সাধুবাবার এমন ক্যারিশ্মা এই এলাকায় প্রায় সকলেই নিজের চোখে দেখেছেন। পর্যটক থেকে স্থানীয় ফটোগ্রাফাররাও জানতেন, সাধুবাবার কাছে ঘণ্ঠাখানেক বসে থাকলেই হস্তি দর্শন হয়ে যেতে পারে। কত পর্যটক এভাবেই ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাতির দর্শন পেয়েছেন। কেউ কেউ সাহ, করে নেমে এসে সেলফিও তুলেছেন।
সারাদিন প্রায় কিছুই খেতেন না। রান্না বান্নার বালাই ছিল না। যে যা দিয়ে যেত, সেই টুকটাক ফল দিয়েই দিন কেটে যেত। ডাক্তারের কাছে যাওয়াতেও ছিল ভয়ঙ্কর অনীহা। বলতেন, প্রকৃতির শরীর। প্রকৃতির মাঝেই আছি। এত ডাক্তার বদ্যির কী দরকার।
এই যে হাতি, চিতাবাঘের মাঝে শুয়ে থাকেন, ভয় লাগে না? সাধুবাবা বলতেন, ওদের ভয় পেতে যাব কেন? ওরাও তো আমাকে ভয় পায় না। ওরাও দেখে আমি একা একা এখানে পড়ে থাকি। আমাক মেরে ওদের লাভ কী? ওরাও জানে, কারা ওদের ভালবাসে।
শোনা যায়, সেই সাধুবাবার কাছে একবার এক চ্যালা এসে জুটেছিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছে হয়েছিল, আশ্রমেই থাকবেন। সাধুবাবার তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাধ সাধল হাতির দল। তারা মাঝে মাঝেই তেড়ে আসত সেই চ্যালার দিকে। সাধুবাবা বারবার হাতিদের নিরস্ত করেছেন। শেষমেশ সাধুবাবা একদিন বললেন, এখানে আমি তো আর সবসময় থাকব না। তোকে একা পেলে ওই হাতিগুলো কী করবে, কে জানে। সেই চ্যালাও বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর উপস্থিতি হাতিদের পছন্দ হচ্ছে না। তাই প্রাণ বাঁচাতে কেটে পড়েন।
সত্যিই তো, ওই গভীর, ঘন জঙ্গলে হাতি, চিতাবাঘদের মাঝে থাকা কি সহজ ব্যাপার? যে কোনও লোককে এক ঘণ্টা একা ছেড়ে দিলে হয়ত হার্ট ফেল করে যাবে। সেখানে সাধুবাবা কুড়ি বছর ধরে কীভাবে কাটালেন!