রুমা ব্যানার্জি
বিগত দুই দশক বা তার বেশি সময় বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বণে’ যুক্ত হয়েছে অনেকগুলি তথাকথিত উৎসব। ধনত্রয়োদশী বা ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী, সংক্ষেপে ধনতেরাস তার অন্যতম। কিছু দিন আগেও এই ধনতেরাস উৎসব শুধু মাত্র অবাঙালিদের বা উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে পালিত হয়ে থাকে ধনতেরাস। ধনতেরাস থেকেই শুরু হয় পাঁচ দিনের দীপাবলি উৎসব। শেষ হয় ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায়। শাস্ত্রমতে ধনতেরাসের দিন মা লক্ষ্মীর পূজার বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। ধনতেরাসের আগে সারা বাড়ি খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হয়। কারণ মা লক্ষ্মী অপরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন না। এইজন্যই ধনতেরাসের দিন সারা বাড়ি, বিশেষ করে মূল প্রবেশ পথের ওপর আলপনা দিতে হয়। মা লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা আঁকা হয়। এরপর নিজের মতো করে মা লক্ষ্মী দেবীকে এবং ধন সম্পদের রক্ষাকর্তা কুবেরের পূজা করতে হয়। অনেকের বিশ্বাস, এইদিনে কোনও ধাতব দ্রব্য কিনলে তা পরিমাণে তেরো গুণ বৃদ্ধি পায়। এই ধারণা থেকেই ধনতেরাসে সোনা রুপা কেনার প্রচলন রয়েছে। তবে শাস্ত্রমতে, এইদিনে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী যে কোনও শুদ্ধ ধাতু কেনায় মঙ্গলজনক। তাতে আসবে সমৃদ্ধি।
কথিত আছে, রাজা হিমার ছেলের এক অভিশাপ ছিল। তার কুষ্টিতে লেখা ছিল, বিয়ের চার দিনের মাথায় সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে। তার স্ত্রীও জানতেন সেই কথা। তাই সেই অভিশপ্ত দিনে সে তাঁর স্বামীকে ঘুমোতে দেননি। শয়নকক্ষের বাইরে তিনি সমস্ত গয়না ও সোনা রূপার মুদ্রা জড়ো করে রাখেন। সেই সঙ্গে সারা ঘরে বাতিও জ্বালিয়ে দেন। স্বামীকে জাগিয়ে রাখতে সারারাত তাঁকে গল্প শোনান, গান শোনান। রাতে যখন মৃত্যুর দেবতা যম তাঁদের ঘরের দরজায় আসেন, আলো আর গয়নার জৌলুসে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। রাজপুত্রের শোয়ার ঘর পর্যন্ত তিনি পৌঁছন ঠিকই। কিন্তু সোনার উপর বসে গল্প আর গান শুনেই তাঁর সময় কেটে যায়। ফলে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যান তিনি। রাজপুত্রের প্রাণ বেঁচে যায়। পরদিন সেই আনন্দে ধনতেরাস পালন শুরু হয়।
পুরাণ মতে, সমুদ্র মন্থনে কুবেরের সঙ্গে উঠে এসেছিলেন দেবী লক্ষ্মী। সেই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি। এই দিনই লক্ষ্মীর আরাধনায় মাতে গোটা দেশ।
মতান্তরে, ধনতেরস সোনার গয়না নয়, আয়ুর্বেদ ওষুধ কেনার দিন। মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য রক্ষায় আয়ুর্বেদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাশীরাজ ধন্বন্তরীর চেষ্টায় আয়ুর্বেদ সারাদেশে প্রসিদ্ধ হয়। তাই আয়ুর্বেদ ও মহৌষধের কথা উঠলেই বলা হয় ধন্বন্তরীর নাম। তিনি ত্রয়োদশী তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তিথি ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী হিসাবে পালিত হয়। হিন্দিতে এটাকে ধন্বন্তরী তেরস বা সংক্ষেপে ধনতেরস বলে।
বৈজ্ঞানিকদের মতে, সব উৎসবের সূচনা হয় ভীতি বা আনন্দের প্রকাশে। সম্ভবত শীতের সময় যাতে খাদ্যের অভাব না হয় তাই কিছু ধন সম্পদ একত্রিত করার রীতি প্রচলিত হয়েছিল। তখন অবশ্য ধন সম্পদ বলতে গবাদি পশু, শস্য বোঝানো হত। খাদ্য শস্য, লবণ, আর তেল মজুত করা হত যাতে পরের শস্য বা ধান পাকা পর্যন্ত ভাঁড়ারে টান না পড়ে। সময়ের বিবর্তনে পরে ধাতু এবং সোনা রূপায় পরিবর্তিত হয় সম্পদের সংজ্ঞা। শুরু হয় সোনা রুপো কেনা। সাধারণ মানুষ যাঁদের তেমন ক্রয়ক্ষমতা ছিল না, তাঁরা বাসনকোসন কিনতেন এই দিনে। কিন্তু কখনই তাঁরা ঝাড়ু–ঝাঁটা কিনতেন না। ইদানিং কয়েক বছর ইউটিউবের দৌরাত্ম্যে এইসব কেনার ধুম পড়েছে। আসলে যে যা বলে দিচ্ছে তার পেছনেই ছুটছে মানুষ।
এই লৌকিকতা প্রায় উৎসবের অঙিনায় পৌঁছে দিয়েছে মিডিয়া। তাই আজ শ্যামা পূজা বা দীপাবলীর সঙ্গে বড় করে উদযাপিত হয় ধনতেরাস। বাঙালি অবাঙালি তাই এখন পঞ্জিকা মেনে পৌঁছে যায় সোনার দোকানে। সেখানে লম্বা লাইন বুঝিয়ে দেয় আমাদের জনজোয়ারে গা ভাসানোর ধুম। খবরের কাগজে, বেতার, দূরদর্শন, পাড়ার মোড়ে, পথের দু–ধারে তাই এখন শুধুই সোনার বিজ্ঞাপন। এমনটা যদি হত তাহলে ধনতেরাসের পর আমরা পৃথিবীর ধনীতম দেশ হয়ে উঠতাম নিশ্চয়ই।
এ বছর ‘ধনতেরাসের ধুম’ দেখে কে বলবে এই দেশের অর্থনীতি অতিমারির কবলে এখন বিধ্বস্ত হয়ে ধুঁকছে। এক শ্রেণীর মানুষের চাকরি নেই। অনেকেই অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ ন্যূনতম পরিষেবা পায় না। সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার প্রাত্যহিক সামগ্রী অগ্নিমূল্য। নুন আনতে এখন পান্তা ফুরাচ্ছে।
এই সময় বিভিন্ন স্ট্যাটাস আপডেটে, সোনা কেনার ছবি, সোনার দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে ছবি দেখে সত্যি বিস্মিত আর ব্যথাতুর হই। ব্যবসায়ী মহলের অাঙ্গুলি হেলনে আর আমরা কতদিন এমন মূর্খের স্বর্গে মেতে থাকব সেটাই এখন দেখার!