‌শূন্য?‌ নাকিনতুন ভোর‌?‌

রক্তিম মিত্র

কোনও কোনও হার জয়ের অধিক। সেটাই যেন মনে করিয়ে দিল ওই ছোট ছোট ছেলেগুলো। তাই শূন্যের মাঝেও ওরা ম্লান নয়। ওরা উজ্জ্বল।

কী আশা করেছিলেন?‌ বামপন্থীরা দেড়শো আসন পেয়ে সরকার গড়বে?‌ নিদেন পক্ষে একশো আসন পেয়ে চমকে দেবে?‌ না, এর কোনওটাই হওয়ার ছিল না। তৃণমূল বা বিজেপি–‌এই দুই দলের কোনও একটি দল জিততে চলেছে, তা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। বামেরা অধিকাংশ আসনেই তৃতীয় হবে, এমনকী জামানতও বাজেয়াপ্ত হবে, এই দেওয়াল লিখনও পরিষ্কার ছিল।

আসন শূন্যে নেমে আসবে, এতটা হয়ত কেউই ভাবেনি। টিভি থেকে কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার রক— নানা জায়গায় নানা বক্রোক্তি ভেসে আসবে, সেটাও স্বাভাবিক। বামেরা কেন ব্যর্থ, তাই নিয়ে বড় বড় পোস্ট এডিট লেখাও হয়ে গেল। চ্যানেলে চ্যানেলে গুরুগম্ভীর আলোচনার আসরও বসল। কিন্তু তারপরেও বলব, এই হারে কোনও লজ্জা নেই। এমনকী এই শূন্যেও লজ্জা নেই। বরং গর্ব আছে, ছেলেগুলো কী দারুণ লড়াইটাই না লড়ল!‌

রেজাল্টের আগেই এসে গিয়েছিল করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। তাই ভোটের পরেও বিশ্রাম নয়, এই ছেলেগুলো পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে। মাঝরাতে কাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কার বাড়িতে অক্সিজেন বা ওষুধ পৌঁছে দিতে হবে, এই ছেলেগুলো সেই দায়িত্ব নিয়ে ফেলল। ভোটে হারের পরেও কোনও হতাশা নেই। শোকপালনের নামে মুখ গুঁড়ে ঘরে খিল দেওয়া নেই। নতুন উদ্যমে ওরা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদিকে সরকারি আস্ফালন। একদিকে এই ছেলেগুলোর সমান্তরাল উদ্যোগ। কঠিন সময়ে কোনটা বেশি ভরসা জুগিয়েছিল?‌

এতদিন বলা হত, সিপিএমের বুড়ো–‌হাবড়া গুলো জোর করে ক্ষমতা দখল করে রাখে। চেয়ার ছাড়তে চায় না। নতুন ছেলেদের জায়গা ছাড়ে না। মোক্ষম জবাব পাওয়া গেল এবার। একঝাঁক নতুন মুখ। কলকাতা বা আশপাশের তরুণরা হয়ত একটু বেশি প্রচার পাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল, জেলায় জেলায় এমনই তরুণ মুখের ছড়াছড়ি। সবমিলিয়ে সংখ্যাটা চল্লিশের কাছাকাছি।

প্রায় প্রত্যেকেই অসম্ভব মেধাবী। চাইলে যে কোনও ভাল চাকরি জুটিয়ে নিতে সমস্যা হত না। কিন্তু এই ছেলেগুলো সব হাতছানিকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে। মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। কী সাবলীল এদের কথাবার্তা। কী শানিত এদের যুক্তি। কী চমৎকার এদের পড়াশোনা। ইতিহাসবোধ থেকে সৌজন্যবোধ, সব ব্যাপারেই এরা আপনাকে মুগ্ধ করে দিতে পারে। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, এই প্রার্থীদের পাশে তৃণমূল বা বিজেপির প্রার্থীদের বসাতে পারবেন?‌ ছেলেগুলোকে দেখলেই কেমন ভালবাসতে ইচ্ছে করে। মুগ্ধ হয়ে এদের কথা শুনতে ইচ্ছে করে। যদি বেছে নিতে বলা হয়, আপনার ছেলে কার মতো হবে?‌ তৃণমূল আর বিজেপির প্রার্থীকে একদিকে রাখুন। আর মীনাক্ষী, দীপ্সিতা, দেবজ্যোতি, পৃথা, শতরূপদের একদিকে রাখুন। নিশ্চিতভাবেই আপনার ভোট এই ছেলেমেয়েদের দিকেই পড়বে।

এরা আজ হয়ত হেরে গেল। আজ হয়ত মানুষ এই উজ্জ্বল ছেলেগুলোকে ফিরিয়ে দিল। কিন্তু লিখে রাখুন, এই একঝাঁক ছেলেমেয়েই বাংলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ। আগামীর দেওয়াল লিখন এরাই লিখবে। তাই আবার বলছি, এই শূন্য আসলে শূন্য নয়। এ শুধু শূন্য থেকে শুরুর ইঙ্গিত।‌‌

 

(‌বেঙ্গল টাইমস শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত।)‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.