ঋষভ সোম
ঠিক এক বছর আগে। সৌরভ গাঙ্গুলির নামটা উঠলেই শুরু হয়ে যেত একটা চাপা গুঞ্জন। তিনি কি সত্যিই রাজনীতিতে আসছেন? তিনিই কি রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী? কথাটা উঠলেই বিজেপির নেতারা মুচকি হাঁসতেন। যেন তলে তলে কথাটা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। শুধু আসাটাই বাকি। আর তৃণমূল নেতৃত্ব! তাঁদের মধ্যেই চাপা চোরা অবিশ্বাস। কী জানি, হয়ত এসে পড়তেই পারেন। তখন কী বলে কাউন্টার করা হবে, সেই নিয়ে নানা চাপা আলোচনাও হয়ত চলত। মোদ্দা কথা, কী হবে, নিশ্চিত করে কারও কাছেই উত্তর ছিল না। আবার ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়াও যেত না। কী জানি, কখন কোনদিকে মোড় ঘুরে যায়। রাজনীতিতে কোনও কিছুই বোধ হয় অসম্ভব নয়।
সত্যিই কি সৌরভের কাছে রাজনীতিতে আসার কোনও প্রস্তাব ছিল না? নিশ্চিতভাবেই ছিল। হয়ত বেশ জোরালোভাবেই ছিল। সৌরভ নিজেও কি একেবারেই ভাবেননি? নিশ্চিতভাবেই ভেবেছিলেন। হয়ত অল্পই ভেবেছিলেন। সৌরভ চাইলে অনেক আগেই সেই গুঞ্জন থামিয়ে দিতেই পারতেন। সাফ জানিয়ে দিতেই পারতেন, ‘আমি কোনও রাজনীতির মঞ্চেই নেই। আপনারা নিশ্চিত থাকুন, ভবিষ্যতেও আমাকে রাজনীতির আঙিনায় দেখতে পাবেন না।’ তিনি একবার এই মর্মে ঘোষণা করে দিলেই সব গুঞ্জন, সব জল্পনা থেমে যেত। কিন্তু তিনি নিজেও নানা সময়ে নানা হেঁয়ালির আশ্রয় নিয়েছেন। কখনও বলেছেন, এখন এটা নিয়ে আলোচনা থাক। কখনও বলেছেন, ভবিষ্যতে কী হতে পারে, কে বলতে পারে! এই মন্তব্যগুলোই জল্পনা বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কখনও তিনি ভারত সেবাশ্রমে গিয়ে ত্রাণ দিয়ে এসেছেন। কখনও নিজের নামে ফাউন্ডেশন খুলে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। এবং অনেকটা কর্পোরেট কায়দায় তার প্রচারও হয়েছে। ভোটের আগে এই উদ্যোগগুলো সেই জল্পনায় আরও একটু অক্সিজেন জোগায় বইকি।
সৌরভ বিজেপিতে আসছেন, এটা নিয়ে যখন জোর জল্পনা, তখন বিজেপির দিক থেকেও সেই জল্পনাকে জিইয়ে রাখা হয়েছিল। সৌরভের প্রসঙ্গ উঠলেই অমিত শাহ বারবার বলেছেন, ‘অনেকের সঙ্গেই আমাদের কথা চলছে। সঠিক সময়ে সব জানতে পারবেন।’ তিনিও বলতেই পারতেন, ‘সৌরভের সঙ্গে এই নিয়ে কোনও কথাই হয়নি। ফলে, এমন কোনওকিছুই ঘটবে না।’ এদিকে জখন এত জল্পনা, তখন মুখ্যমন্ত্রী কি সম্পূর্ণ নিরুদ্বেগ ছিলেন? সৌরভের গতিবিধিতে কোনও নজরদারি ছিল না? এটা হতে পারে? তাঁর দিক থেকে সৌরভের মনোভাব বোঝার চেষ্টা হয়নি? তাঁর দিক থেকে সৌরভকে বোঝানোর চেষ্টা হয়নি? সৌরভ বা মুখ্যমন্ত্রী, কোনও পক্ষই বিষয়টাকে সামনে আনেননি। হয়ত কোনওদিনই আনবেন না। কিন্তু কোনও কথা হয়নি, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
এরই মধ্যে বছরের গোড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন সৌরভ। দু’দুবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। অপারেশনও হল। বোঝাই যাচ্ছে, একটা সাঙ্ঘাতিক মানসিক চাপ তাঁর ভেতর কাজ করছিল। কী করা উচিত, কতটা এগোনো উচিত, নিজেও হয়ত বুঝে উঠতে পারছিলেন না। খেলোয়াড় জীবনে অফ স্টাম্পের বাইরের কত বল পা বাড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার উল্টোটাও তো হয়েছে। কভার ড্রাইভ মারতে গিয়ে বাইরের বল খোঁচাও দিয়েছেন। বল চলে গেছে তৃতীয় স্লিপে। দু’ এগিয়ে এসে সেই বিখ্যাত ‘বাপি বাড়ি যা’ শট। সেখানে বল কখনও ব্যাটের মাঝখানে লেগে উড়ে গেছে গ্যালারিতে। আবার কখনও ক্যাচও কি ওঠেনি?
রাজনীতির জীবনটাও অনেকটা ক্রিকেটের মতোই। কোন বলটা খেলবেন, কোন বলটা ছাড়বেন, এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাটের মাঝখানে লাগলে তবু ঠিক আছে। কিন্তু ক্যাচ উঠে গেলেই বিপদ। শোনা যায়, সৌরভ তাঁর মতো করে সমীক্ষা করেছেন। পেশাদারি সংস্থাকে দিয়েও নাকি সমীক্ষা করিয়েছেন। এই রাজ্যে বিজেপির সম্ভাবনা কতটা, কোন জেলায় কী পরিস্থিতি, বোঝার চেষ্টা করেছেন। খুব ঘনিষ্ট কিছু লোকের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। কী কী কুৎসা ও আক্রমণ নেমে আসতে পারে, অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন। সব বুঝে পা বাড়িয়ে বলটা ছেড়েই দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মুখের ওপর ‘না’ করাও কঠিন। ওদিকে, ক্রিকেট বোর্ডের সমীকরণ বদলে যাবে। সেখানে তাঁকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। আবার ‘হ্যাঁ’ করলে জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা। সবমিলিয়ে বেশ উভয় সঙ্কট। বিজেপি জিতলে হঠাৎ ড্যাং ড্যাং করে এসে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার রাস্তাও হয়ত খোলা ছিল। কিন্তু বিজেপি ধরাশায়ী হওয়ায় আর কাদা লাগানোর ঝুঁকিটা নিতে হল না। যেভাবে মিঠুর চক্রবর্তীর মতো হিরোকে প্রায় নাস্তানাবুদ ও হাসির খোরাক হতে হল, সৌরভের ক্ষেত্রে তেমনটা হল না। অনেকে বলতেন, সৌরভ রাজনীতির কী বোঝেন? দেখা গেল, বোঝেন। অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই বোঝেন।