একটি সোনা ও বদলে যাওয়া বাণিজ্য

তৃষাণ রুদ্র

এই দেশের খেলাধুলায় একটা কথা হামেশাই শোনা যায়, ক্রিকেট নাকি সব খেলাকে গিলে খাচ্ছে। ক্রিকেটের আগ্রাসনের কাছে অন্য সব খেলা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগটা বহু পুরনো। আটের দশক থেকেই ভেসে উঠছে। আইপিএল জমানায় তা আরও জোরালো হয়েছে।

অভিযোগটা কি একেবারেই মিথ্যে?‌ তাও তো বলা যাবে না। সত্যিই তো, একজন মাঝারিমানের ক্রিকেটার যে প্রচার পান, অন্যান্য খেলার একেবারে সামনের সারির খেলোয়াড়রা তার সিকিভাগও পান না। হার্দিক পান্ডিয়া আর অভিনব বিন্দ্রা যদি পাশাপাশি হেঁটে যান, প্রথমজনকে অনেক বেশি লোক চিনবেন। বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে সেলফি তুলতে যত না ভিড় হবে, তার থেকে ঢের বেশি ভিড় হবে ঋষভ পন্থ বা শ্রেয়স আয়ারকে ঘিরে। আর শচীন, সৌরভ, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের তুলনা এলে তো কথাই নেই। অন্য খেলা একেবারে শুরুতেই নকআউট।

শুধু জনপ্রিয়তা নয়, বাণিজ্যের নিরিখেও ফারাক এতটাই। হয়ত আরও বেশি। কিন্তু এবারের অলিম্পিক অন্তত একটা বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন বিরাট কোহলির ঘাড়ে সজোরে নিশ্বাস ফেলছেন নীরজ চোপড়া। কোহলিকে ছাপিয়ে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বিপণনের দুনিয়া বড়ই নিষ্ঠুর। সে চলে তার বিচিত্র নিয়মে। তার ওঠাপড়ার গ্রাফটাও একেবারে অন্যরকম। কখন ওঠে, কখন নামে, বলা মুশকিল। যে কোহলিকে ঘিরে একসময় এত রমরমা, সুখী দাম্পত্যের এত ঘটা করে বিজ্ঞাপন, মাত্র কয়েকমাসেই সেই গ্রাফ পড়তির দিকে। টি২০ বিশ্বকাপে বড় মাপের সাফল্য না এলে সেই গ্রাফ আরও পড়বে।

কিন্তু নীরজের ক্ষেত্রে এখনই সেই আশঙ্কাটা নেই। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা নাকি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি চাইছে এই সোনাজয়ী অ্যাথলিটের সঙ্গে। অন্তত আগামী প্যারিস অলিম্পিক পর্যন্ত। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সব অঙ্ক। যেসব চুক্তি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, বা হওয়ার অপেক্ষায় আছে, সেই অঙ্কটাই কোহলিকে ছাপিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। নতুন যে সব প্রস্তাব আসবে, সেগুলো হিসেব করলে সেই অঙ্ক হয়ত ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। মোদ্দা কথা, আগামী তিন বছর বিজ্ঞাপন আর এনডোর্সমেন্টের হিসেবে নীরজের ধারেকাছেও কেউ থাকবেন না।

লড়াইটা বিরাট কোহলি বনাম নীরজ চোপড়ার নয়। এই প্রথম একজন ক্রিকেটারকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন একজন অ্যাথলিট। এখানেই যেন অন্য এক আবহ তৈরি করে দিয়ে গেল টোকিও অলিম্পিক। কখনও ডাক পড়ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। কখনও রাষ্ট্রপতির কাছে। কখনও কৌন বনেগা ক্রোড়পতির সেটে, বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের মুখোমুখি। আর আজ এই রাজ্যে, কাল ওই রাজ্যে সংবর্ধনা তো আছেই। কোনওদিন তাঁর নামে নামকরণ হচ্ছে সেনাবাহিনীর স্টেডিয়ামের, কখনও বায়োপিক করতে চেয়ে ভিড় করছেন পরিচালকরা। ৭ আগস্টের পর থেকে জীবনটাই বদলে গেছে নীরজের। কিন্তু সংবর্ধনার জোয়ারে ভেসে থাকলেই তো হবে না। এই জোয়ারে কত তারকাকে ভেসে যেতে দেখেছেন। জানেন, সামনের পথটা কতটা রুক্ষ। তাই যতই স্পনসর বা এনডোর্সমেন্ট আসুক, পা ফেলছেন বেশ সন্তর্পণে। অ্যালকোহল বা সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেখলে পা বাড়িয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন সেই প্রলোভনের বিষাক্ত সুইংটা। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু সংযমটাও দিব্যি আছে।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.