এখন পাড়ায় পাড়ায় বিদ্যাসাগর

নন্দ ঘোষের কড়চা

সোশ্যাল সাইটে এখন বিদ্যাসাগরকে নিয়ে পোস্টের বন্যা। ২০০ বছর বলে কথা। স্বভাবতই পোস্ট এডিটোরিয়াল আর ফেবু পোস্টের হিড়িকটা একটু বেশি। সেই আবহে নন্দ ঘোষের কড়চার সেই লেখা আবার ফিরিয়ে আনা হল। বিদ্যাসাগরকে দু—চার কথা শুনিয়ে দিলেন নন্দ ঘোষ।

nanda ghosh logo

আপনি নাকি বিদ্যাসাগর। তা, এমন নামটি কে দিয়েছিল মশাই ? যেই দিয়ে থাকুক, আপনি একবারও বারণ করলেন না ? সবাই আপনাকে দিব্যি বিদ্যাসাগর বলে চিনে গেল। আপনি মনে মনে বেশ মজা পেলেন। পদবী উড়ে গেল। নতুন পদবী এসে গেল।
বিদ্যা নাকি বিনয়ী করে। আপনার তো মশাই অনেক বিদ্যা ছিল। তাহলে বিনয়ী হননি কেন ? কেন নিজেকে বিদ্যাসাগর বলে ঢাক পেটাতেন ? একবার তো বারণ করতে পারতেন।
আপনার সঙ্গে মশাই একজনের খুব মিল পাচ্ছি। একটা সুলভ শৌচাগার উদ্বোধন করতে গিয়েও পাড়ার কাউন্সিলরদের বলতে হয়, অমুকের অনুপ্রেরণায় জনসাধারণের জন্য এই শৌচাগারটি করা হল। সব বিজ্ঞাপনে তাঁর বড় ছবি। বড় বড় হোর্ডিংয়ে তিনি। তিনি একবার বারণ করলেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি বারণ করেন না। শুনেছি, কোন ছবিটা কোন বিজ্ঞাপনে যাবে, নিজে নাকি বেছে দেন। তিনি সবার অনুপ্রেরণা। এখন বুঝছি আসল নাটের গুরু আপনি। আপনি বোধ হয় তাঁর অনুপ্রেরণা।
আপনি নাকি মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দামোদর পেরিয়েছিলেন। যারা দুর্গাপুর ব্যারেজ দিয়ে পেরিয়েছে, তারা ভাবে দামোদর মানে বোধ হয় বিশাল কিছু। আপনি যে দামোদর পেরিয়েছেন, সেটা মোটেই চওড়া নদী নয় । টালি নালার থেকে একটু বড়। সেই নদী পেরিয়ে এত বলার কী আছে মশাই ? যারা আপনাকে নিয়ে তিন-চার লাইন জানে, তারাও জানে আপনার নদী পেরোনোর কথা। এই বাংলার কত লোক ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে গেল, কেউ তাঁদের খোঁজও রাখে না। আর আপনি একটা নালার মতো নদীর পেরিয়েছেন (সত্যি কিনা সন্দেহ আছে), সেটা কিনা টেক্সট বুকে এসে গেল। এবার বুঝছি, কেন কেউ কেউ নিজেকে সিলেবাসে আনতে চাইছেন।

vidyasagar4

কলকাতা আসতে আসতে মাইলস্টোন দেখে আপনি নাকি সংখ্যা চিনেছিলেন। ভাবুন, কত পিছিয়ে ছিলেন। এখন দু বছরের এক ছোকরা কিনা মোবাইল গেমস খেলছে। চার বছরে চ্যাট, হোয়াটস আপ করছে।
কোন এক সাহেবের মুখের উপর আপনি টেবিলে জুতো তুলে বসেছিলেন। সেই সাহেব নেহাত ভদ্রলোক ছিল। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়েছিল। এখন যদি বুড়ো বয়সে পিএইচডি করা শিক্ষামন্ত্রী ঢুকত, পারতেন ওই ভাবে বসে থাকতে ? শিক্ষামন্ত্রী তো অনেক দূরের কথা মশাই। প্রফেসর বঙ্কু বা কোনও ‘দায়িত্বশীল’ ছাত্রনেতা ঢুকত, হাড়ে হাড়ে টের পেতেন। আপনার হাড় হিম হয়ে যেত।
হয়ত আপনার ভোটে দাঁড়ানোর শখ হল। আপনার বীরসিংহগ্রাম কোথায় ? খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ঘাটালের কাছাকাছি। সেখান থেকে আপনি টিকিট পেতেন ? কোনও চান্স নেই। ওখানে ‘দেব’ আছে। দেব থাকতে লোকে আপনাকে টিকিট দেবে কেন ? অতএব, আপনাকে থাকতে হত ‘নিষ্ফলের, হতাশের দলে’। নইলে ‘আঙুর ফল টক’ এর মতো বলতে হত, রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস।

রাতে ঘুমিয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আপনি টিকি বেঁধে রাখতেন। যেন ঘুমিয়ে গেলেই টান পড়ে। এখন কাউকে টিঁকি বেঁধে রাখতে হয় না। ওরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। বিশ্বাস না হলে, গভীর রাতে ওদের ফেসবুক বা হোয়াটস আপ স্ট্যাটাস দেখুন। দেখতে পাবেন, ‘অনলাইন’। আপনি অবশ্য পুরানো যুগের মানুষ। এসব বুঝবেন না।

wi-fi

আপনি নাকি ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে পড়তেন। এখন এই দৃশ্য হামেশাই দেখতে পাই। শহরের নানা জায়গায় ওই ল্যাম্প পোস্টের তলায় মোবাইল নিয়ে সারাক্ষণ একদল ছোকরা কী যেন করে যায়। এটুকু বলতে পারি, বই হাতে আপনার যত না নিষ্ঠা ছিল, স্মার্টফোন হাতে এই ছোকরাদের ‘নিষ্ঠা’ আপনার থেকে ঢের বেশি। আপনার তবু ল্যাম্প পোস্টের আলো দরকার হত। এদের আলোর দরকার হয় না। আলো না থাকলেও এদের নিষ্ঠায় কোনও ঘাটতি আসে না।

তাহলে কী দাঁড়াল। আপনি একাই বিদ্যাসাগর নন। আপনার মতো বিদ্যাসাগর এখন পাড়ায় পাড়ায়। তাহলে খামোখা আপনাকে মহাপুরুষের আসনে বসাবো কেন ?

(নন্দ ঘোষের কড়চা। নিছকই একটি মজার কলাম। বিদ্যাসাগরকে অসম্মান করার বা ছোট করার কোনও ইচ্ছেই আমাদের নেই। যাঁরা নিয়মিত পড়েন, তাঁরা জানেন। কিন্তু যাঁরা নতুন পাঠক, তাঁরা এই কলামকে মজা হিসেবেই দেখুন। এই লেখা থেকে যেন কোনও ভুল বার্তা না যায়।)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.