কুণাল দাশগুপ্ত
খানিকটা উৎসাহের বশেই মাকে ফোন করে বসলাম। বিশ্বকর্মা পুজোর বিকেল। কিছুটা বদলে গিয়েছে। আগের মতো ঘুড়ি ঢাকা আকাশ আর নেই। ওপরে তাকালে মনে হয়, ইতস্তত কিছু ঘুড়ি আপনমনে নেচে বেড়াচ্ছে। কান পাতলাম দুওহো, ভোকাট্টা শব্দগুলো শোনার জন্য। গড়িয়ার মোড়ের আকাশ খানিকটা ঝকঝকেই। তবে শুনতে চাইলাম বিশ্বকর্মার একটি মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে কিশোর–লতার উনসত্তরের ডুয়েট, কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা।
এত বছর পরেও তারুণ্যে ভরপুর। জেট গতিতে মন ছুটল সেই শৈশবের দেশে। আর আবেগের ঘাড়ে চেপে মাকে ফোন করলাম...আজও বাজছে। উত্তর এল, কী? বললাম, বিশ্বকর্মার প্যান্ডেলে কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা।
মাযের দিক থেকে পাল্টা প্রশ্ন ভেসে এল, ‘আর শ্যামল মিত্রর কিছু হচ্ছে না! আমি তোমার কাছেই ফিরে আসব বা কী নামে ডেকে বলব তোমাকে!’
ফোন কাটার আগে বললাম, বিশ্বাস নেই, কোনও না কোনও প্যান্ডেলে শুনতেই পারি।
গড়িয়া অটো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছি আর মনে মনে বলছি, জিও শচীনকর্তা, সুরের বিশ্বকর্মা বস তুমিই। মনের ভেতর বসে আছে, নড়েও না, মরেও না। অটো থেকে যাদবপুরে নামার মুখে কানে এল নাল আর ঢোলের আওয়াজ। তারপর শীবের জয়ধ্বনি। ফাটিয়ে বেজে চলেছে ‘জয় জয় শিবশঙ্কর’। স্মৃতির খানাখন্দ টপকে চললাম বেহালার সেনহাটি কলোনির দিকে। ওখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা। পি ১৯ বাড়ির উল্টোদিকে একটা জলের ট্যাঙ্ক রয়েছে। ওখানে প্রতিবছর বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ‘আপ কী কসম’ বাজত। তথাকথিত পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা মনপ্রাণ ঢেলে আন্তরিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে সেই গানের সঙ্গে নাচত। এরকম বহু গান গানমেলার মতো বেজে চলল।
তখন কটা হবে, সন্ধে সাতটা। বাঘাযতীন অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অটোর আশা যখন ছেড়েই দিচ্ছি, তখনই আশার উদয়। ভেসে এল ...কোন অজানা, কোন অচেনা, আজ কিছুতেই যায় না চেনা। আশা ভোঁশলের গান। ভাবলাম, আশা ভোঁসলেকে এভাবে ব্যবহার কি ওপি নাইয়ার বা রাহুল দেব বর্মনও করেছিলেন! সুধীন মৃত্যুহীন। রাতে যখন বাড়ি ফিরছি, তখন এক প্যান্ডেলে বেজে চলেছিল, কতদিন পরে এলে! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বেসিক ডিস্ক। সত্যিই তো, কতদিন পরে প্যান্ডেলে এই গানগুলো শুনছি।
এখানে থিমওয়ালাদের খবরদারি নেই। স্পন্সরদের চাপ নেই। মেকি বুদ্ধিজীবী হওয়ার হিড়িক নেই। এখানে যে যেমন, সে তেমনই। পুজো কমিটির লোকেরা বেশিরভাগই মাঝবয়সী। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত আবহেই তাঁদের বেড়ে ওঠা। অনেক প্রাণখোলা, মেকি ব্যাপারটা খুবই কম। বেড়ে ওঠার সময়ে যে গান শোনা, সেই গানগুলোই তাঁরা বাজান। ভাল–মন্দের ফারাকটা তাঁরা শৌখিন উদ্যোক্তাদের থেকে বেশিই বোঝেন। তাঁরাই তো মহাকালের দূত, এক দশক থেকে অন্য দশকে পৌঁছে দেন সেইসব অমর হয়ে থাকা গান। অন্য পুজোর থেকে এই পুজোর শ্রেণিচরিত্রটা সত্যিই অন্যরকম।
দানবীর ইউটিউব দাতা কর্ণ হয়ে বছরভর এসব গান আমাদের বিলিয়ে যায়। তবু পুজো প্যান্ডেলে আর তেমন একটা চলে না। সারা বছর রবি ঠাকুর আর পান্নালালকে চিলেকোঠায় তুলে রাখলেও বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এঁদের গান বাজানোই এখন একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে বিশ্বকর্মার উদ্যোক্তারা অনেকটাই অকৃত্রিম। আবেগের গায়ে ভদ্রলোকের রঙচঙে লেবেল লাগাননি। ভাগ্যিস বিশ্বকর্মায় পুরস্কার–টুরস্কার হানা দেয়নি!