রক্তিম মিত্র
তেমন ইঙ্গিত ছিল না। হঠাৎ করেই ঘটে গেল ঘটনাটা। রাতের দিকে হঠাৎ জানা গেল, অর্পিতা ঘোষ নাকি রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন।
আনন্দে কেউ পদত্যাগ করে না। পদত্যাগ যখন করেছেন, তখন নিশ্চয় কিছু কারণ আছে। আর সেটা আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু সেই তিক্ততা নিয়ে হইচই হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তাতে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। কে আর চটাতে চায়!
অর্পিতার দাবি, তিনি নাকি নিজে থেকেই পদত্যাগ করেছেন। দল নাকি এরকম কোনও নির্দেশ দেয়নি। অর্পিতা হয়ত চাইছেন না আর তিক্ততা বাড়ুক। তাই তিনি এরকম বিবৃতিই দিলেন। তাঁর জায়গা থেকে হয়ত এমন বিবৃতি আসাই স্বাভাবিক।
কিন্তু রাজ্যসভার সাংসদের পদ তিনি নিজের ইচ্ছেয় ছেড়ে দিলেন? এটা বিশ্বাসযোগ্য? অন্তত অর্পিতা ঘোষের যা ট্র্যাক রেকর্ড, তারপর এই দাবি বিশ্বাস করা যায়? তিনি নাকি সংগঠনের কাজ করতে আগ্রহী। তাই রাজ্যসভায় থাকতে চাননি। এই কথা যদি অনুব্রত মণ্ডল বলতেন, বিশ্বাস করা যেত। তৃণমূলের আর কারও সম্পর্কেই কথাটা খাটে না। অর্পিতা সম্পর্কে তো একেবারেই খাটে না।
লোকসভায় হেরে যাওয়ার পর তাঁকে দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা সভাপতি করা হয়েছিল? কেমন সংগঠন চালিয়েছিলেন? সংগঠনের ওপর কতখানি ভরসা রেখেছিলেন? পদে পদে ডিএম আর এসপি–কে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। পুলিশের পাইলট কার নিয়ে ঘুরেছেন। সরকারি প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে যা ইচ্ছে, তাই করেছেন। মোদ্দা কথা, প্রতি পদে পদে পুলিশ নির্ভরতায় আচ্ছন্ন ছিলেন।
নির্বাচিত সাংসদ সুকান্ত মজুমদার করোনার সময় ত্রাণ দিতে গেলে তাঁকে বারবার পুলিশ আটকে দিয়েছে। হেনস্থা করেছে। আর অর্পিতা পরাজিত প্রার্থী হয়ে পুলিশ এসকর্ট নিয়ে মাঝে মাঝে জেলায় এসেছেন। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর কাছে অপমানিত হয়ে যাঁরা দল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন, পুলিশ দিয়ে তাঁদের হেনস্থা করিয়েছেন। ভয় দেখিয়ে কাউকে কাউকে ফিরিয়ে এনেছেন। রাজ্যসভায় পুনর্বাসন পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই দাপট, এই দর্প আরও বেড়ে গিয়েছিল।
সেই অর্পিতা কিনা বলছেন, তিনি সংগঠনের কাজ করতে চান। তিনি নাকি এমপি থাকতে চাইছেন না। মোদ্দা কথা, দল পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে, তাই করেছেন। নইলে, ক্ষমতা ছাড়ার বান্দা তিনি নন। তাঁর সামনে অন্য একটা উপায় ছিল। দলের নির্দেশ না মানা। দল যা বলছে বলুক, ইস্তফা দেব না। কিন্তু এটা করলে কী কী পরিণতি হতে পারে, তিনি বিলক্ষণ জানেন। কারণ, তিনি তাঁর দলকে চেনেন। তাই মানে মানে সরে গেলেন। যদি পরে অন্য কোনও পুনর্বাসন জুটে যায়!
মোদ্দা কথা, ওই আসনে দল অন্য কাউকে পুনর্বাসন দিতে চায়। তাই কাউকে একটা সরতে হত। মৌসমকেও হয়ত বলা যেত। কিন্তু তাহলে অন্য বার্তা যেত। এতখানি ঝুঁকিও মুখ্যমন্ত্রী নিতে চাননি। সেদিক থেকে অর্পিতা সফ্ট টার্গেট। তাঁকে পরে অন্য কিছু ‘পাইয়ে’ দিলেই হবে। আর নানা অভিযোগ তো ছিলই। সেই অঙ্কেই অর্পিতার ঘাড়ে খাড়া নামল।
তিনি নাকি সংগঠনের কাজ করেই আনন্দ পান। তাহলে, আগামীদিনে সংগঠন ছাড়া অন্য কোনও দায়িত্ব নেবেন না তো? পেছনের দরজা দিয়ে অন্য কোথাও ঢুকে পড়বেন না তো? দেখার অপেক্ষা রইল। অতীতে রেলের কমিটি থেকে শুরু করে শিশু কিশোর অ্যাকাডেমি, নাট্য আকাদেমি থেকে অ্যাকাডেম অফ ফাইন আর্টস— যেখানে যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন, ঢুকে পড়েছেন। মাতব্বরি মাতব্বরি ফলিয়েছেন। হঠাৎ তাঁর মানসিকতা বদলে গেল? হতে পারে? সাংগঠনিক স্তরে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এই পদের মূল্য কতটা, আর কেউ না জানুক, অর্পিতা বিলক্ষণ জানেন। একসময় শঙ্কুদেব পন্ডার মতো অর্বাচীনরাও এই পদে ছিলেন। সেই পদ পেয়ে দুবারের সাংসদ অর্পিতা যদি নিজেকে সম্মানিত মনে করেন, তাহলে বুঝতে হবে, হয় তিনি রাজনীতির কিছুই বোঝেন না অথবা ডাঁহা মিথ্যে বলছেন।
তিনি নাকি নাটকের পেছনে আরও সময় দিতে চান। খুব ভাল কথা। কিন্তু সেখানেও তো সেই কর্তৃত্ব ফলানো ছাড়া আর কিছুই নেই। নাট্যকর্মী হিসেবে যত না পরিচিতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য পরিচিতি তার থেকে ঢের বেশি। কে হল পাবে, কে পাবে না, তিনিই নির্ধারণ করতেন। নাট্য জগতের লোকেদের জিজ্ঞেস করুন। এমন কত নমুনা পেয়ে যাবেন। আর তাঁর নাটকের কল শো? কোন কোন জেলায় হয়েছে, কারা আয়োজক, একবার তালিকা সামনে এলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২০১১–র পর থেকে কার্যত হুমকি দিয়ে বিভিন্ন পুরসভা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয়েছে তাঁর নাটক করাতে। কটা নাট্যদল সেই আয়োজন করেছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আয়োজক কোনও না কোনও পুরসভা। যে পুরসভার চেয়ারম্যান জীবন কোনওদিন কোনও নাটক দেখেননি, তিনিও বাধ্য হয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে তাঁর নাটকের দলকে আমন্ত্রণ জানাতে। নইলে, চাকরি থাকবে না। সেই সময়ের পুরসভার চেয়ারম্যানদের জিজ্ঞেস করুন। অনেকেই এমন শীতল হুমকির শিকার। প্রশাসনিক মহলে এটা ওপেন সিক্রেট।
মোদ্দা কথা, তিনি দলকেও ভালবাসেন না। সংগঠের প্রতি কোনও প্রীতিও নেই। তিনি বোঝেন কর্তৃত্ব। তিনি বোঝেন মাতব্বরি। প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকলে তিনি অনেকটা জল ছাড়া মাছের মতোই। তৃণমূল নেতৃত্ব চাইলে একবার পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কোনও প্রশাসনিক পদে তাঁকে না বসিয়ে দেখুন। যাঁদের ‘দম বন্ধ’ হয়ে আসবে, একেবারে সামনের সারিতেই থাকবে একটি নাম— অর্পিতা ঘোষ।
অর্পিতা থাকবেন সংগঠনে! হাসালেন কত্তা
