এত ব্যস্ততার মাঝেও চিঠি লিখতে ভুলতেন না

ব্যস্ততার মাঝেও কীভাবে সময় বের করে নিতে হয়, তিনি জানতেন। চিঠি লেখায় তাই বিরাম পড়েনি। নিয়মিত পাঠকদের চিঠির উত্তর দিতেন। তাঁর লেখা চিঠি কত হাজার হাজার পাঠকের কাছে সারাজীবনের সম্পদ হয়ে আছে। বোঝা গেল, যাঁরা সত্যিকারের ব্যস্ত, তাঁরা ঠিক সময় বের করে নিতে জানেন। লিখেছেন উত্তম জানা।

যাঁরা ব্যস্ত মানুষ, তাঁরা বোধ হয় ঠিক সময় বের করে নিতে পারেন। যাঁরা ততখানি ব্যস্ত নন, তাঁরাই বোধ হয় ‘‌সময় নেই’‌ অজুহাত দেন। বুদ্ধদেব গুহ যেন এই চরম সত্যিটাই আরও বেশি করে দেখিয়ে গেলেন।

গত কয়েকদিন অনেকেই নানারকম স্মৃতিচারণ করেছেন প্রয়াত লেখকের। সেই স্মৃতিচারণে মোদ্দা যে কথাটা উঠে এসেছে, তা হল, তাঁকে চিঠি লিখলে উত্তর পাওয়া যেত। বিখ্যাত লোকেদের তিনি হয়ত প্রচুর চিঠি লিখেছেন। সেগুলি নানা জায়গায় সংকলিতও হয়েছে। কিন্তু একেবারে সাধারণ পাঠকদেরও নিরাশ করেননি। যে কেউ চিঠি লিখে তাঁর উত্তর পেয়েছেন। কেউ পত্রিকা পাঠালে তিনি পড়েছেন। মতামত জানিয়েছেন। সেই চিঠিগুলি পাঠকের কাছে পরম এক সম্পদ হয়ে আছে। গত কয়েকদিনে সোশ্যাল মিডিয়া বা হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপে এমন অসংখ্য চিঠির সন্ধান পাওয়া গেল।

buddhadeb guha

বুদ্ধদেব গুহ কি খুব কম ব্যস্ত ছিলেন?‌ দিনে প্রায় বারো ঘণ্টা সময় এমন আবহে কাটিয়েছেন, যার সঙ্গে সাহিত্যের সুদূরতম সম্পর্কও নেই। তিনি ছিলেন একজন অন্যতম সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আজ এই ট্রাইব্যুনাল, কাল ওই ট্রাইব্যুনালে ঘুরতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে, প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এর সিকিভাগ ধকল নিয়েই আমরা হয়ত ক্লান্ত হয়ে যেতাম। মনে হত, ঢের করেছি। এবার বিশ্রাম নেওয়া দরকার।

আর উনি কী করেছেন?‌ এই জঙ্গল থেকে ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে নিবিঢ়ভাবে মিশেছেন। একের পর এক কালজয়ী লেখা লিখে গেছেন। পড়াশোনার পেছনেও বড় একটা সময় ব্যয় করেছেন। সেই তালিকায় অতীতের কালজয়ী লেখকরা যেমন আছেন, বর্তমান সময়ের একেবারে অনামী লেখকরাও আছেন। খুব কম সাহিত্যিকই অন্যের লেখা পড়েন। যাঁরা পড়েন, সেই তালিকায় একেবারে অগ্রগন্য বুদ্ধদেব গুহ। নিয়মিত অন্যের লেখা পড়তেন, চিঠি লিখে উৎসাহ দিতেন।

হ্যাঁ, এই চিঠি লেখা। যে কাজটা এখন প্রায় উঠেই গেছে। তিনি কিন্তু এই বিরল শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। নিজের দৈনন্দিন জীবনচর্চার অঙ্গ করে তুলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় নাকি ভোরে উঠেই চিঠি লিখতে বসতেন। বুদ্ধদেব গুহ কখন চিঠি লিখতেন?‌ সকালের দিকে?‌ নাকি রাতের দিকে?‌ নাকি কাজের ফাঁকে?‌ জানি না। দিনে ঠিক কতগুলো চিঠি লিখতেন, তাও জানি না।

এই ফেসবুক, টুইটারের যুগে আর কোনও লেখক কি এভাবে পাঠককে চিঠি লেখেন?‌ তাও জানি না। হয়ত হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর দেন। হয়ত দু এক লাইনের মেসেজ করেন। কিন্তু বুদ্ধদেব গুহ না কম্পিউটারের লিখেছেন। না স্মার্টফোনে উত্তর দিয়েছেন। তিনি সরাসরি চিঠিই লিখতেন।

বোঝা গেল, যাঁরা সত্যিকারের ব্যস্ত মানুষ, তাঁরা ঠিক সময় বের করে নিতে পারেন। আর যাঁরা পারেন না, তাঁরাই ব্যস্ততার অজুহাত দেন। যাঁরা তেমন সাহিত্য অনুরাগী নন, তাঁদের কাছেও অন্তত এই একটা ব্যাপারে মোক্ষম শিক্ষা দিয়ে গেলেন কিংবদন্তি এই মানুষটা।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.