‌পনেরোই আগস্ট এলেই বাঙালি যে গান গাইবে….

স্বরূপ গোস্বামী

পাড়ায় আজকাল আর মাইক বাজে না। রেকর্ডের যুগ তো কবেই ফুরিয়েছে। ক্যাসেটও যেন লুপ্তপ্রায় প্রজাতি। তবু গান কিন্তু থেমে নেই। নানা বিবর্তনের পরেও নানা উপলক্ষে সে ঠিক বেজে ওঠে। সে পঁচিশে বৈশাখ হোক বা পয়লা জানুয়ারি। সে ছাব্বিশে জানুয়ারি হোক বা পনেরোই আগস্ট।

আচ্ছা, পনেরোই আগস্ট এলেই কোন বাংলা গানটা সবার আগে মনে পড়ে? বেশি ভাবার দরকার নেই। চটপট বলে ফেলুন, ভারত আমার ভারতবর্ষ। আচ্ছা, এটা কার গান? পাড়ার মোড়ে বা রকের আড্ডায় একটু সমীক্ষা করে দেখুন তো। বিচিত্র সব উত্তর পাবেন। কেউ বলবেন এটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কেউ বলবেন অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্ত। তাও যদি না মেলে, তাহলে বাঙালির চিরন্তন রবি ঠাকুর তো আছেনই। এরপরেও যদি বলেন, উত্তর ঠিক হল না, তাহলে যাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, তিনি আপনার সঙ্গের্তর্কও জুড়ে দিতে পারেন।

গানের শেষ স্তবকগুলো একটু মনে করুন। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বীর সুভাষের মহান দেশ/ নাহিকো ভাবনা, করি না চিন্তা/ হৃদয়ে নাহি কো ভয়ের রেশ। রবীন্দ্রনাথ নিজে কখনও এমন লাইন লিখতে পারেন! কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাঙালি যখনই কোথাও আঁটক যায়, ওই একটি ঠাকুরের নাম স্মরণ করে, তা হল রবি ঠাকুর।

chinmoy-roy

অথচ, এই গানের যিনি গীতিকার, সেই শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর বছর খানেক আগেও আমাদের মাঝে বেঁচে ছিলেন। যিনি সুরকার, সেই অজয় দাস, আর যিনি গেয়েছিলেন, সেই মান্না বছর চারেক আগেও আমাদের মধ্যে ছিলেন। এই গান অন্তত আড়াইশোটি স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত। স্বদেশ পর্যায়ের গান বলতে প্রথমের সারিতেই উঠে আসে এই গান। পনেরোই আগস্ট বা ছাব্বিশে জানুয়ারি মানেই কোথাও না কোথাও বেজে উঠবে এই গান। অথচ, এই গানের জন্মবৃত্তান্ত জানলে আপনাকে অবাক হতে হবে। গানটি কী ভেবে লেখা হয়েছিল? না, দেশাত্মবোধক তো দূরের কথা, কোনও সিরিয়াস মুহূর্তের কথা ভেবেও নয়। বরং কিছুটা কমেডির আদলে। ভাবতে পারেন, সিনেমায় চিন্ময় রায় এই গান গাইবেন, সেই ভেবে গানটি লেখা হয়েছিল!

চারমূর্তি ছবির কথা নিশ্চয় মনে পড়ছে। টেনিদা রূপী চিন্ময়ের কথাও নিশ্চয় মনে আছে! পরিচালক বললেন, ছবিতে টেনিদার লিপে এই গানটি থাকবে। যে টেনিদা প্রচন্ড সাহসী হওয়ার ভান করে, কিন্ত আসলে প্রচন্ড ভিতু। সেই টেনিদা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইবে। কী গান তৈরি করা যায়! পরিচালক বললেন ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ এই জাতীয় কোনও গানের আদল থাকবে। শিবদাসবাবু লিখতে বসে গেলেন। লিখে ফেললেন ভারত আমার ভারতবর্ষ/স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো। অজয় দাস সুরও দিয়ে ফেললেন। রেকর্ড করানো হল মান্না দে–কে দিয়ে।

ছবিটা মুক্তি পেল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই গানটা অন্য এক মাত্রা পেয়ে গেল। মুখে মুখে ফিরতে লাগল। এমনকি পনেরোই আগস্ট বাজতে লাগল। সেখান থেকে নানা স্কুলের প্রার্থনা সঙ্গীত হয়ে গেল। কখনও ভেবেছিলেন, এই গান এমন জনপ্রিয়তা পাবে? বছর খানেক আগে তাঁর নাকতলার বাড়িতে বসে জানতে চেয়েছিলাম শিবদাসবাবুর কাছে। অকপটেই বললেন, ‘শুধু আমি কেন, কেউই ভাবেনি। কী করে যে কী হয়ে গেল! অথচ, যেগুলো খুব সময় নিয়ে লিখি, সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছয় না।’ এই গানকে ঘিরে অনেক অভিমান ছিল শিবদাসবাবুর। তাঁর পাড়াতে বা আশেপাশে বাজত এই গান। পতাকা তুলতেন কাউন্সিলর বা ক্লাবের সেক্রেটারি। অথচ, তাঁকে কেউ মঞ্চে ডাকত না। শেষেরদিকে বেরোতে পারতেন না। মাইকেই শব্দ কানে আসত। টিভি চালালেও কোনও না কোনও চ্যানেলে বেজে উঠত এই গান। কিন্তু কেউ গীতিকারের খোঁজ রাখেননি। একবুক অভিমান নিয়েই চলে গেছেন।

প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল অজয় দাসের ক্ষেত্রেও। তিনি যে এমন এক কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া গানের সুরকার, সেটা কজনই বা জানতেন! অজয় দাসের নাম যাঁরা জানেন, তাঁরা পরের লাইনেই জুড়ে দেন, সুখেন দাসের ভাই। যেন নিজস্ব কোনও পরিচিতি নেই! তাঁকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম এই গানের কথা। বলেছিলেন, ‘মান্নাদা নিজেও বুঝতে পারেননি। নিছক মজার ছলেই সুর করা হয়েছিল। কিন্তু এই গান যে এমন জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, কে জানত! কাউকে বলি না, এই গান আমার সুর করা। কারণ, লোকে হয়ত বিশ্বাসও করবে না। ভাববে মিথ্যে বলছি।’

শিবদাসবাবু চলে গেছেন, অজয়বাবুও নেই। মান্না দেও নেই। হারিয়ে গেছেন চিন্ময়ও। বাঙালি শিকড় হারিয়ে এক অজানা পথে ছুটবে। বিনোদনের কত অজানা দিক হাজির হয়ে যাবে। দেশপ্রেমের কত নতুন আঙ্গিক বেরিয়ে আসবে। তবু পনেরোই আগস্ট এলেই এই গান বাঙালিকে শুনতেই হবে এই গান।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.