রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতার শেষ নেই। একটা সমীক্ষা করুন, কজন জোড়াসাঁকোয় গিয়েছেন। খাস কলকাতায় হাজারে একজনও পাবেন কিনা সন্দেহ। এই হল রবি ঠাকুরের প্রতি বাঙালির ভালবাসার নমুনা। লিখেছেন সজল মুখার্জি ।।
বালক সত্যজিৎ রায়কে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিখ্যাত সেই কবিতাটির শেষ লাইন হল, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।’
এই কবিতাটি সব থেকে বেশি সত্যি রবীন্দ্রনাথের নিজের বাড়ি সম্বন্ধে। আমরা তাজমহল দেখেছি, মথুরা-বৃন্দাবন দেখেছি, সুদূর লাদাখে গিয়ে গুম্ফা দেখেছি, কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে হ্যানা প্যালেস, ত্যানা ম্যানসন দেখে এসেছি। কিন্তু বুকে হাত রেখে বলুন তো, কজন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি গেছি?
হ্যাঁ শান্তিনিকেতনে অনেকেই গেছি। কিন্তু সে তো প্রকৃতি দেখব বলে, বসন্ত উৎসবে নাচ দেখব বলে। রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, তার জন্মকক্ষ, প্রয়াণকক্ষ কজন দেখেছি? মহাআঁতেল রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কিছু না জানুক, তার বৌদির কথা জানে। কিন্তু কারও মনে কি ইচ্ছা হয়েছে, সেই বৌদির ঘরটি দেখে আসি? যে ঘরের সামনে কিশোর রবীন্দ্রনাথ, আর তাঁর বউদি গল্প করতেন।
অথচ যাতায়াতে কোনও অসুবিধা নেই। বাসে বা মেট্রোতে চেপে এক ঘণ্টার মধ্যেই যাওয়া যায়। মেট্রোয় গিরিশ পার্কে নেমে হেঁটে বড়জোর মিনিট দশেক। টিকিট কাটতে হয় না, লাইন দিতে হয় না, পুলিশ বডি সার্চ করে না। ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ ভিড় হয়, অন্য দিনগুলো ফাঁকাই থাকে। যান না ঘুরে আসুন। কত জায়গায় তো সেলফি তোলেন, এবারের সেলফিটা না হয় রবি ঠাকুরের বাড়িতেই তুললেন। দেখবেন ফেসবুক হোয়াটস্যাপে বাড়তি লাইক পাবেন। আরও ভালো হয় যদি ফেরার পথে কলেজ স্ট্রিট থেকে সঞ্চয়িতা, গীতবিতান বা গল্পগুচ্ছ কেনেন। সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে কিছু আনকমন কোট ঝাড়ুন, দেখবেন, আপনাকে ঘিরে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, কমেন্ট, লাইকের বান ডেকে যাবে।
কিন্তু বাঙালি ইকো পার্কে যাবে। মাল্টিপ্লেক্সে যাবে। প্রেমের নতুন নতুন জায়গায় যাবে। সানি লিওন এলে হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দেখতে চলে যাবে। ইডেনে আইপিএল দেখতে যাবে। সেই বাঙালিকে জিজ্ঞেস করুন কখনও জোড়াসাঁকোয় গেছেন কিনা। নিশ্চিত থাকুন, হাজারে একজন বড়জোর বলবেন, তিনি গিয়েছেন। দু একজন গিয়েছি বলে নির্ঘাত গুল মারবেন। বাকি কেউ কেউ হয়ত আকাশ থেকে পড়বেন। হয়ত নামটাই জীবনে প্রথম শুনলেন। হ্যাঁ, এরাই বাঙালি। এরাই মূলস্রোত বাঙালি। যাঁরা ঠাকুরবাড়ি গিয়েছেন, তাঁরা নিতান্তই সংখ্যালঘু। এরপরেও বলতে হবে বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসে!