আপনার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ কিন্তু ওটাই

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ কী জানেন? দুনিয়ার না হোক,এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের     জন্য সবচেয়ে সোজা যে কাজটা, যেটা করতে কোনও ভাবনাচিন্তার দরকার হয় না, সেটা কী, জানেন? সেটা হল বঙ্গ সিপিআইএমের সমালোচনা করা। শুধু নিজে সমালোচনা করাই নয়, অপরকেও সমালোচনা করতে উৎসাহিত করা। বিশ্বাস করুন, ‘‌এমন সোজা কাজটি কোথাও খুঁজে পাবেন নাকো আপনি’‌।

red volantire

২ মে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকে বাংলার মানুষের এখন রোজনামচা হয়ে গেছে বঙ্গ সিপিআইএম কে তুলোধনা করা। সত্যিই তো, এমন সোজা কাজ মনে হয় এই মুহূর্তে আর দ্বিতীয় নেই। ঘরে বাইরে, পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে, বাসে বা গাড়িতে অফিস যেতে যেতে মুখে মাস্ক পরেই হোক বা না পরেই হোক, একটাই আলোচনা। সিপিআইএম এটা না করে, ওটা করলে নির্বাচনে ভাল করত। এর সঙ্গে জোটে না গেলে শূন্য হত না। ওই সিদ্ধান্তটা নিলে বরং কিছু আসন পেত। ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি হয়তো, আপনার ছেলে–‌মেয়ের চাকরি নেই দীর্ঘদিন। গ্র্যাজুয়েট হয়ে ঘরে বসে আছে। দায়ী কে ? বঙ্গ সিপিআইএম। ওদের জন্যই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে বেকার। ওদের জন্যই রাজ্যে ফ্যাক্টরি হয়নি। নইলে ‘‌মা মাটি মানুষের সরকার’‌ তো ‘‌দুয়ারেই’‌ এসে গেছে। বাড়ির দুয়ার থেকে একদম হাত ধরে মার্সিডিজ গাড়িতে চাপিয়ে ছেলে–‌মেয়েকে অফিসে নিয়ে গিয়ে চাকরি দিয়ে দিত কিনা! আপনার পেনশনের টাকা আটকে আছে। দায়ী কে? বঙ্গ সিপিআইএম। ওরাই সরকারি অফিসে ওদের লোক বসিয়ে রেখেছে কিনা, তাই পেনশনের টাকা আপনি পাচ্ছেন না। নইলে মা মাটি মানুষের এমন ‘‌জনদরদী’‌ সরকার কবেই আপনার প্রাপ্য সব টাকা দিয়ে দিত। পেট্রোলের দাম লিটারে ১০০ টাকা, গ্যাসের দাম হাজার ছুঁই ছুঁই। সরষের তেলের দাম লিটারে ১৮০ টাকা। দায়ী কে? সেই সিপিআইএম। ওরা আন্দোলন করছে না বলেই তো, খরচ সামলাতে আপনার নাভিশ্বাস উঠছে কিনা! আসলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিত্যপ্রয়োজ়নীয় জিনিসের দাম কমাতে। কিন্তু সিপিআইএম ই তো কিছু করছে না!

বস্তুত এমনটাই হল বাংলার সিংহভাগ মানুষের মনের রসায়ন। সবকিছুর জন্য দায়ী সেই সিপিআইএম–‌ই। শুধু তাই নয়, গত বিধানভা নির্বাচনে সিপিআইএম কী করলে ভাল হত, কী করলে বাংলায় কিছু আসন পেত, কী করলে ভোটপ্রাপ্তির শতাংশ বৃদ্ধি পেত—এরকম আলোচনা সর্বত্র। এই ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে কত নতুন নতুন ব্লগার, বর্ষাকালে বাড়ির উঠোনে ব্যাঙের ছাতার মত গজ়িয়ে ওঠা কত শত নিত্যনতুন পোর্টাল! সেখানে কত মুখরোচক আলোচনা প্রতিনিয়ত লেগেই আছে। সিপিআইএম কে নিয়ে বাংলার মানুষ এখনও এতটা ভাবেন, এখনও এতটা কাটাছেঁড়া করেন, এখনও আলোচনার (পড়ুন সমালোচনার) কেন্দ্রবিন্দুতে ১০ বছর আগে ক্ষমতাচ্যুত সেই সিপিআইএম??

সে আপনি যা খুশি করতেই পারেন, সে স্বাধীনতা আপনার পূর্ণমাত্রায় আছে বৈকি! কিন্তু একান্তে আয়নার সামনে নিজের মুখটা মাঝেমধ্যে একটু দেখবেন,এই আর কি। মুখটা মানে আপনার ‘‌রাজনৈতিক মুখ’‌টা। আপনি নিজে কোন রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, সেটা একটু নিজে যাচাই করে নেবেন। সিপিআইএম কংগ্রেস বা আই.এস.এফের সঙ্গে জ়োট করে নির্বাচনে লড়েছিল বলে একটাও আসন পায়নি, এই আপনার বিশ্বাস। খুব ভাল কথা। প্রশ্নটা এটাই যে, জোটটা না করলে আপনি ভোট দিতেন? ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তো এই জোট ছিল না। সিপিআইএম কে ভোট দিয়েছিলেন সেদিন ? নিজেকে প্রশ্ন করুন। যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আড্ডার আসরে সিপিআইএমের খুঁত খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাঁদেরকেও প্রশ্নটা করুন। কেন ২০১৯ সালে নন্দিনী মুখা‌র্জি বা দেবেশ দাস বা বিকাশ ভট্টাচার্যদের বদলে অর্জুন সিং, দিলীপ ঘোষ, মিমি চক্রবর্তীরা সেদিন সাংসদে যাওয়ার ছাড়পত্র পেলেন? যদি আপনি বা আপনার বাড়ির লোকজন বা সেই আড্ডার ব্যক্তিবর্গ ২০১৯ সালে সিপিআইএম কে ভোট দিয়ে থাকেন, তাহলে ঠিক আছে। যত ইচ্ছে সমালোচনা করে যান। কিন্তু যদি না দিয়ে থাকেন, তাহলে এই বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বা আই.এস.এফের সঙ্গে সিপিআইএমের জ়োট না হলেও আপনি কি ভোট দিতেন? আপনার তো টিকিটি বাঁধা আছে অন্যত্র।

red volantire2

আপনার দৃষ্টির সামনে এই নির্বাচনে শোচনীয় ফলাফলের পরেও একটা দলের কয়েকশো তরুণ-তরুণী নিজেদের জীবনের বা অতিমারী থেকে সুরক্ষার কথা না ভেবে সারা রাজ্যজুড়ে করোনা আক্রান্তের বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছে, মরণাপন্ন করোনা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র যেখানে বেড পাওয়া গেছে, সেখানে ভর্তি করার সর্বোতো চেষ্টা চালিয়ে গেছে, দিবারাত্র বাংলার নানা স্থানে করোনা আক্রান্তের বাড়িতে রেশন থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস পৌঁছে দিয়ে এসেছে। আর আপনি? নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর থেকে টিভির পর্দায় দেখছেন এই রাজ্যের একজন সাংসদ অবধি করোনার ভুয়ো ভ্যাক্সিনের শিকার। দেখছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত হয়েও কি নির্লজ্জের মত নন্দীগ্রাম বিধানসভাতে মানুষের রায় বদল করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি তাঁর এই “লড়াই” কে সাধুবাদ জানাচ্ছেন নিশ্চয় ? টিভির পর্দায় কতগুলো নীতিহীন, ক্ষমতালোভী ‘‌রাজনৈতিক বেশ্যা’‌দের এ দল ছেড়ে ও দলে যোগ দেওয়া দেখে আপনি হয়ত মনে মনে বা প্রকাশ্যেই তাঁদের উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করে যাচ্ছেন আর পাঁচজন আত্মীয়বন্ধুকে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘‌এই জন্যই তো সিপিআইএম শূন্য’‌ !

আপনার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ ওটাই। বঙ্গ সিপিআইএমের সমালোচনা করে যাওয়া।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.