রক্তিম মিত্র
আগে ভাইরাল বললে বোঝাত ভাইরাল জ্বর। গত কয়েকবছর এই শব্দের মানেটাই কেমন বদলে গেছে। এখন ভাইরাল বললে এসে যায় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এইসব। মোদ্দা কথা, কোনও লেখা বা কোনও ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে বলা হয়, ভাইরাল হয়ে গেছে।
তিন দশক আগে এসব সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। সারাক্ষণ খবরওয়ালা চ্যানেল ছিল না। ব্রেকিং নিউজ নামক শব্দটা ছিল না। কিন্তু একটি কথা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। যা আজও ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও শ্লীলতাহানি হলে গলা ফুলিয়ে কেউ কেউ বলতে থাকে। এমনকী বামেদের যেখানে হেয় করার দরকার হয়, সেখানে চিমটি কাটার মতো এই কথাটা ব্যবহার হয়।
বাক্যটা হল, ‘এমন তো কতই হয়।’ দিব্যি এই কথাটা জ্যোতি বসুর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। অথচ, এই কথাটা জ্যোতি বসু কোনওদিন উচ্চারণও করলেন না। তা সত্ত্বেও কী অবলীলায় তাঁর নামে চালিয়ে দেওয়া হল। টিভির তর্ক বিতর্কে মাঝে মাঝেই তৃণমূল বা বিজেপির প্রতিনিধি এই কথাটা জ্যোতি বাবুর নামে চালিয়ে দেন। আর সেই চ্যানেলে হাজির বাম নেতা তখন মাথা নামিয়ে কার্যত স্বীকার করেই নেন। এখনও পর্যন্ত কাউকেই বলতে শুনলাম না, ওটা জ্যোতিবাবু বলেনননি। অথচ, সত্যিই জ্যোতিবাবুর মুখ থেকে ওই বাক্যটা বেরোয়নি।
বানতলায় যেদিন নৃশংস ঘটনাটি ঘটে, সেদিন জ্যোতি বসু রাইটার্সেই ছিলেন। সম্ভবত, বিকেলের দিকে খবরটি পৌঁছয়। তখন মোবাইল ছিল না। তবু, প্রেস কর্নারে সাংবাদিকদের কাছে নানা সূত্র থেকে খবর ঠিক এসে যেত। কোনও কোনও সাংবাদিক জানতেন, বানতলায় এরকম একটি নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। সন্ধে নাগাদ জ্যোতিবাবুর ঘরে গেলেন সাংবাদিকরা। বানতলার ঘটনা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন। প্রশ্নটা ছিল ইংরাজিতে। স্বভাবতই জ্যোতিবাবু উত্তর দিলেন, ‘ভেরি স্যাড।’ আবার কোনও এক ইংরাজি কাগজের সাংবাদিক ইংরাজিতেই প্রশ্ন করলেন, যার মানে, আপনি কি স্বীকার করছেন, পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে? জ্যোতিবাবুও ইংরাজিতেই জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইট হ্যাপেন্স।’ তারপর আরও কয়েক লাইন বললেন, যার নির্যাস, ‘ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। কখনও কখনও এমন দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। কিন্তু এটা মোটেই গোটা রাজ্যের পরিস্থিতি নয়। একটা ঘটনা দিয়ে গোটা রাজ্যের পরিস্থিতি বিচার করা ঠিক হবে না।’ জ্যোতিবাবু অনেক সময় বাক্য সম্পূর্ণ করতেন না। তাই, যেটা বলতে চাইছেন, অনেক সময় পরিষ্কার হত না। বিভ্রান্তির কিছু অবকাশ থেকে যেত।
কিন্তু ওই যে ‘ইট হ্যাপেন্স’। একটি বাংলা কাগজে তার বাংলা তর্জমা হয়ে গেল ‘এমন তো কতই হয়।’ সেটাই দশকের পর দশক ধরে ভাষণে ভাষণে ছড়িয়ে গেল। কেউ কেউ নিজের মতো করে অতিরঞ্জিত করে বসলেন। আজও সেই অতিরঞ্জনের ট্রাডিশন চলছে। আজও কোথাও নারী নির্যাতন ঘটলে তৃণমূল নেতারা বলে থাকেন, ‘বাম আমলেও এসব হত। সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো বলেছিলেন, এমন তো ঘটতেই পারে। এমন তো কতই হয়। এ নিয়ে হইচই করার কী আছে?’ বলা হয়, বানতলায় যে এত এত নারীর ধর্ষণ হল, তার কোনও বিচার হয়েছে? সব ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। ঘটনা হল, সেই ঘটনায় পরেরদিনই পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। তাদের অপরাধ প্রমাণ হয়েছে কয়েক বছরের মধ্যেই। সবাই যাবজ্জীবন জেল খাটছে। কিন্তু মিথ্যা প্রচারটা থেকেই গেছে।
যেমনভাবে থেকে গেছে, এমন তো কতই হয়!
****
জ্যোতি বসুর স্মরণে বেঙ্গল টাইমসের বিশেষ সংখ্যা।
পড়তে হলে নীচের ছবিতে ক্লিক করুন। ই ম্যাগাজিনটি দ্রুত পড়ে ফেলুন।
ওয়েব লিঙ্ক দেওয়া হল। সেখানে ক্লিক করেও পড়তে পারেন।
https://www.bengaltimes.in/Bengaltimes-JyotiBasuIssue.pdf