গাভাসকার হলেন সেই তেনজিংয়ের মতোই, এভারেস্ট বললেই যাঁর কথা মনে পড়ে যায়। গাভাসকারের জন্মদিনে কৈশোরের সেই সোনালি মুহূর্তগুলো তুলে আনলেন দিব্যেন্দু দে।।
আশির দশককে ফিরে দেখা। নিঃসন্দেহে দারুণ এক উদ্যোগ। আমাদের অনেকেরই ছেলেবেলা কেটেছে এই আশির দশকে। তখন অনেককিছুই বুঝতাম না। কিশোর মনে কত এলোমেলো ভাবনা এসে ভিড় করত। সেইসব চরিত্র পরে হয়ত হারিয়ে গেছে। আবার কিছু কিছু স্মৃতি অমলিন হয়েই থেকে গেছে।
ছোটবেলায় সবার যা ভাল লাগে, আমারও তাই ভাল লাগত। ক্রিকেট। না, কপিলের নেতৃত্বে ভারত যখন বিশ্বকাপ জিতল, তখন ক্রিকেট বোঝার মতো বয়স হয়নি। আমি ক্রিকেট ভালবাসতে শুরু করলাম, তার বছর দুই পরে। তাই বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপও সেভাবে মনে নেই। আমার ভাল লাগার জগৎ জুড়ে তখন একটাই নাম। সুনীল গাভাসকার। বাড়িতে তাঁরই ছবি টাঙানো। গাভাসকার রান পেলে দিনটা অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে কেটে যেত। আবার গাভাসকার রান না পেলে সারাটা দিন কেমন যেন মনমরা লাগত। যেদিন ভারতের খেলা, সেদিন স্কুল–টিউশনি সব বন্ধ। কত বকুনি খেয়েছি। কিন্তু মনে হত, গাভাসকারের জন্য এসব সহ্য করাই যায়। তাই আশির দশকে আমার কাছে সবথেকে আনন্দের দিন হল গাভাসকারের দশ হাজার রানের মাইলস্টোনে পৌঁছনো। আবার সবচেয়ে দুঃখের দিন হল গাভাসকারের অবসর ঘোষণা।
দুটো ঘটনাই ঘটেছিল সাতাশি সালে। আজও মনে আছে সেই মুহূর্তটা। আমেদাবাদে ইজাজ ফাকির বলে লেট কাট মেরে সোজা দৌড়লেন ওই মানুষটা। পৌঁছে গেলেন দশ হাজার রানের মাইলস্টোনে। ক্রিকেট মাঠে ইজাজ ফাকির তেমন কোনও মনে রাখার মতো কীর্তি নেই। ক্রিক ইনফো ঘেঁটে দেখলাম, ৫ টি টেস্টে মাত্র ৪ টি উইকেট পেয়েছেন পাকিস্তানের এই অফব্রেক বোলার। অমরত্ব পাওয়া একটা ছবিতে তিনিও একটি চরিত্র। কারণ, ওই লেট কাট মেরেই দশ হাজার রানের মাইলস্টোনে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুনীল গাভাসকার।
২০১৭ সালে দাঁড়িয়ে বোঝানো যাবে না দশ হাজার রানের মাহাত্ম্য কী। কারণ, উইকিপিডিয়ায় একটু চোখ বোলালেই এই প্রজন্মের ছোকরা বলবে, মোট বারো জন ১০ হাজারের উপর রান করেছেন। শচীনের রান তো প্রায় ষোল হাজার (১৫৯২১)। রাহুল দ্রাবিড়ের রান ১৩২৮৮। এঁরা সবাই গাভাসকারের থেকে অনেক এগিয়ে। যে বারোজন এই মাইলস্টোন পেরিয়েছেন, তাঁদের সবার নিচে গাভাসকারের নাম। হ্যাঁ, পরিসংখ্যান হয়ত তাই বলবে। আচ্ছা বলুন তো, এভারেস্ট জয়ী বলতে কার কথা সবার আগে মনে পড়ে? তেনজিং নোরগে। ঠিক তেমনি। দশ হাজার রানের মাইলস্টোন যদি এভারেস্ট হয়, তবে সুনীল গাভাসকার হলেন ক্রিকেটের তেনজিং। তেনজিংয়ের সঙ্গে তবু না হয় হিলারি ছিলেন (বা উল্টোটা), কিন্তু গাভাসকার ওই শৃঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন সম্পূর্ণ একা।
সেদিনই গাভাসকার বলেছিলেন, রেকর্ড তৈরি হয় ভাঙার জন্যই। আমার এই রানের রেকর্ড নিশ্চয় একদিন ভেঙে যাবে। তবে আমি খুশি হব, কোনও ভারতীয়র ব্যাটে যদি এই রেকর্ড ভাঙে। গাভাসকারের ১০১২২ কে প্রথম টপকে ছিলেন অ্যালান বর্ডার। কিন্তু সর্বোচ্চ রানের শৃঙ্গে শচীন। এই রেকর্ড কি কোনওদিন ভাঙবে? টানা এতদিন আর কেউ এভাবে খেলে যেতে পারবেন? ভবিষ্যতই উত্তর দেবে। তবে এখন এসব প্রশ্ন থাক। হিমালয়ের শৃঙ্গে ওঠার তিরিশটা বছর কেটে গেল। গাভাসকার আপাতত ধারাভাষ্যে ব্যস্ত।
ক্রিকেটে যতই নতুন নতুন কীর্তি স্থাপিত হোক, আমার কাছে ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানের নাম এখনও সুনীল গাভাসকার। এখনও এই মানুষটা কিছু বললে পরম মুগ্ধতায় শোনার চেষ্টা করি। এখনও এই মানুষটাকেই ভারতীয় ক্রিকেটের বিবেক মনে হয়। সেই ভাল লাগার জন্ম হয়েছিল আশির দশকেই। তখন প্রেমে পড়ার মতো বয়স ছিল না। তাই সে অর্থে প্রথম প্রেম ওই বেঁটে মারাঠি লোকটার সঙ্গেই। আশির দশক আমাকে শিখিয়েছিল সব সংকীর্ণতা ভেঙে একজন মারাঠির প্রেমে পড়তে। তাই আমার কাছে আশির দশক মানে ওই একটি মানুষ, যিনি একটা ব্যাট দিয়ে সারা বিশ্বকে শাসন করছেন।