মাত্র এক টাকায় কেনা হয়েছিল সল্টলেক? কীভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিধানচন্দ্র রায়? স্মৃতিচারণে প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।।
সল্টলেকে জমির দাম কত? কত হতে পারে, অনুমান করুন। তাহলে, গোটা সল্টলেকের দাম কত? মাথা ঘুরে যাওয়ারই কথা। অথচ, গোটা সল্টলেকের দাম ধার্য হয়েছিল মাত্র এক টাকা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আর এই কান্ডটাই করে দেখিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়।
স্বাধীনতার পর তখন পিলপিল করে ওপার বাংলা থেকে আসছে উদ্বাস্তুরা। ছড়িয়ে গেল বাংলার নানা জায়গায়। এত এত মানুষ থাকবে কোথায়? খাবে কী? কর্মসংস্থানই বা হবে কোথায়? সমস্যা বেশ গুরুতর। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ। একদিন ডেকে পাঠালেন প্রফুল্ল সেনকে।
মন্ত্রীসভার কাজ চালানোর ব্যাপারে প্রফুল্লবাবুর ওপর অনেকটাই নির্ভর করতেন। প্রফুল্লবাবুকে নিজের ঘরে ডেকে বললেন, পূর্ব কলকাতায় অনেক জলা জমি আছে। অনেক ভেড়ি আছে। সেগুলি বুজিয়ে ফেলতে হবে। এবং এই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। শুনেই মাথায় হাত প্রফুল্ল সেনের। তিনি বললেন, ‘সেটা কী করে সম্ভব? পুরো জায়গাটাই তো আমাদের হেমদার।’ হেমদা মানে, হেমচন্দ্র নস্কর, বিধান রায়ের ক্যাবিনেটে তিনিও একজন মন্ত্রী। বয়সে বিধানবাবুর থেকেও বড়। তাঁর জায়গা নিয়ে নেওয়া হবে! বিধানচন্দ্র বললেন, ‘যেভাবে হোক হেমদাকে বুঝিয়ে রাজি করাও।’
প্রফুল্ল সেন পড়লেন মহা সমস্যায়। খোঁজ নিলেন সেচমন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্করের। তখনও তিনি মহাকরণে ঢোকেননি। আধঘণ্টা পর পর ফোন হেম নস্করের ঘরে। এবার হেম নস্কর বললেন, কী ব্যাপার বলো তো। তোমরা তো আমাকে মন্ত্রী বলে মনেই করো না। আমাকে কোনও গুরুত্বই দাও না। আজ হঠাৎ এতবার খোঁজ কেন? ঠিক আছে, তোমার ঘরে যাচ্ছি।’ প্রফুল্ল সেন বললেন, ‘আপনাকে আসতে হবে না, আমি আপনার ঘরে আসছি। ডাক্তার রায়ের আপনাকে দরকার।’
হেম নস্করকে একরকম পাকড়াও করেই নিয়ে গেলেন বিধান রায়ের কাছে। হেম নস্কর ভাবলেন অন্য কথা। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। মাছ লাগবে তো! ঠিক আছে, আপনাকে বড় মাছ পাঠিয়ে দেব। আর প্রফুল্ল, তমিও তো মাছ খেতে ভালবাস। তোমাকেও মাছ পাঠিয়ে দেব।’ তখন বিধান রায় বললেন, ‘না না, মাছের কথা বলছি না। প্রফুল্ল, হেমদাকে বুঝিয়ে দাও আমরা কী করতে চাইছি।’
প্রফুল্লবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘হেমদা, আমরা পূর্ব কলকাতায় একটা নতুন উপনগরী করতে চাইছি। তার জন্য আপনার ওই ভেড়িগুলো বুজিয়ে ফেলতে চাই।’ শুনেই আঁতকে উঠলেন হেম নস্কর। ওগুলো দিয়ে দিলে আমি খাব কী?’ বিধানবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘আপনার অনেক টাকা আছে। ওগুলো না থাকলেও আপনার দিব্যি চলে যাবে। সরকারের হাতে টাকা নেই, তাই আপনার যা প্রাপ্য, সেই দাম দিতে পারব না। তবে একেবারে বিনামূল্যে নেব না। এক টাকা দেব।’
পরিকল্পনা সাজানোই ছিল। ঘরে ঢুকে পড়লেন চিফ সেক্রেটারি। হাতে নকশা। আর জমি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। ওই ঘরে বসিয়েই সই করিয়ে নেওয়া হল হেম নস্করকে। বেচারা মন্ত্রী! ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই বিধানবাবুর কথায় সই করে ফেলতে হল।
আগে থেকেই সল্টলেকের নকশা তৈরি করে রেখেছিলেন বিধান রায়। ফলে, কাজ শুরু হতে সময় লাগল না। দ্রুত শুরু হয়ে গেল সল্টলেক তৈরির কাজ। পুরো কাজটা বিধানবাবু দেখে যেতে পারেননি। আজকে আমরা যে সল্টলেক দেখছি, তার প্রায় পুরোটাই ছিল বিধান রায়ের পরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টির ফসল। কিন্তু সেই সল্টলেক যে মাত্র এক টাকায় কেনা হয়েছিল, এটা কজন জানেন!