(৫ জুন। বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিমের জন্মদিন। স্মৃতির অ্যালবামে সহজেই ধুলো জমে যায়। আমরাও ভুলেই গেছি হাসিম আব্দুল হালিমকে। বেসুরো এই লেখার মধ্যে দিয়ে একটু ফিরে দেখা।)
স্বরূপ গোস্বামী
কেমন স্পিকার ছিলেন হাসিম আব্দুল হালিম সাহেব? চারপাশে যা সব দেখছি, সেই মানদন্ডে মোটেই ভাল কিছু বলা যাবে না। অনেক ত্রুটি মশাই, অনেক ত্রুটি। আসলে, স্পিকার হতে গেলে যা যা গুণ দরকার, তার অনেককিছুই ভদ্রলোকের মধ্যে ছিল না। নেহাত মিডিয়া ছিল না। পুচ্ছপাকা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। তাই সবকিছু আড়ালে থেকে গেছে। চাইলে অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু পড়ার এত সময় কই? তাই দশ দফায় তাঁর ব্যর্থতার কাহিনী তুলে ধরা যাক।।
১) স্পিকারের চেয়ারে বসে যে সবসময় ডানদিকে তাকাতে হয়, তিনি জানতেনই না। সত্যিই তো, মুখ্যমন্ত্রী বা নম্বর টু রেগে যেতেই পারেন। তার থেকে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই বাস্তব বোধটাই তাঁর ছিল না।
২) সহজ কথা, সরকার যেমন চাইবে, তেমনই বিধানসভা চলবে। মুখ্যমন্ত্রী পছন্দ করেন না, এমন কোনও কথা কেউ বলতে পারবে না। বিরোধীরাও না। তাঁদেরও মুখ্যমন্ত্রীর গুণগান গাইতে হবে। নইলে বলতে দেওয়া হবে না। বললেও রেকর্ড থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এই ব্যাপারটা উনি বুঝতেন বলে মনেই হয় না।
৩) গিলোটিন। শব্দটা যে দেশ থেকেই আসুক, বিধানসভায় এটার দারুণ ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন বিভাগের বাজেট আলোচনা ছাড়াই পাশ হয়ে যাওয়া। এত আলোচনার কী দরকার বাপু? জনগণ ভোটে জিতিয়েছে, মন্ত্রী যা করবেন, সেটাই চূড়ান্ত। এত বিতর্ক, আলোচনার কী আছে? মন্ত্রীদের কত কাজ। এর মধ্যে বিধানসভায় বিতর্কে অংশ নিতে বলাটা সত্যিই খুব অপরাধ। মুশকিলটা হল হালিম সাহেব এটা বুঝতেনই না। সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ নিয়ে আলোচনা হত। বিরোধীরা সমালোচনা করতেন। উল্টো যুক্তি তুলে ধরতেন। এসব ঝামেলা এড়িয়ে চললেই তো ভাল। সহজ উপায়, পুলিশ–শিক্ষা–স্বাস্থ্য–পঞ্চায়েত–শিল্প সব বাজেট গিলোটিনে পাঠিয়ে দাও। আলোচনা যদি করতেই হয়, মৎস্য, কুটির শিল্প, সমবায়— এসব নিয়ে করো। এই সহজ ব্যাপারটাই বুঝতেন না।
৪) প্রশ্নোত্তর পর্ব। অর্থাৎ বিধায়করা প্রশ্ন জমা দেবেন, মন্ত্রী উত্তর দেবেন। হালিম সাহেবের আমলে এটাই হয়ে এসেছে। এমনকী মন্ত্রী যদি উত্তর না দিতেন বা দেরি করে আসতেন, সেই মন্ত্রীই ধমক খেতেন। বলুন তো, এসবের কোনও দরকার ছিল? বিধায়কদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তারা প্রশ্ন করতেই পারে। তাই বলে মন্ত্রীকেও উত্তর দিতে হবে! ভারী অন্যায়। কিন্তু ওই লোকটা এসব কিছুই বুঝতেন না।
৫) মুলতুবি প্রস্তাব। এটাও বিধানসভার প্রচলিত একটা প্রথা। কোনও বিষয় আলোচনা চেয়ে মুলতুবি প্রস্তাব আনা যায়। তিনি অ্যালাও করতেন। এমনকি খুব অযৌক্তিক দাবি হলেও প্রস্তাবটা পড়তে অন্তত দিতেন। সেই বিধায়ক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা চাইছেন, এটা অন্তত বোঝা যেত, রেকর্ড থাকত। এত ঝামেলার কী দরকার? সহজ কথা, আলোচনা হবে না। আলোচনাই যখন হবে না, তখন পড়তেই বা দেব কেন?
৬) দলবদল। মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া যায়। বিরোধী থেকে শাসক দলে এলেই দোষ? কেউ তো ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল হতে চাইতেই পারে। বাইরে যা ঘটছে ঘটুক, চোখ বুজে থাকলেই হল। আমি জানি না বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। সময়ের পর সময় দেওয়া যায়, যেন পরের ভোট এসে যায়। ভদ্রলোকের পারফরমেন্স সত্যিই খুব খারাপ। এত বছর স্পিকার রইলেন। একজনও বিরোধী বিধায়ককে শাসক দলে আনা গেল না। এটা তাঁর চরম ব্যর্ততা।
৭) তাঁর সময়ে এক বাম বিধায়ক স্টিং অপারেশনে ধরা পড়লেন। উনি তদন্ত কমিশন বসিয়ে দিলেন। এখানেই শেষ নয়। সেই কমিটির চেয়ারম্যান করে দিলেন বিরোধী দলের বিধায়ককে। বলুন তো, কোনও বিচক্ষণ লোক এটা করে? কিন্তু উনি করেছিলেন। ফল কী হল? সেই বিধায়ক প্রায় কোনও দোষ না করেই আগেভাগেই পদত্যাগ করলেন। কত স্টিং অপারেশন হয়, সাজানো ভিডিও বলে দিলেই হত। বা যদি সত্যিও হয়, চক্রান্ত তো বলাই যেত। তা না করে উনি ঘটা করে তদন্ত কমিশন গড়ে ফেললেন। কী করে লোহাচোর বা দলবদলুদের বাঁচাতে হয়, শিখেই উঠতে পারলেন না।
৮) উনি বলতেন হাউস বিরোধীদের। এখানে বিরোধীদের অধিকার থাকবে। কথায় কথায় জ্ঞান সিং সোহনপাল, জয়নাল আবেদিন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সৌগত রায়দের পরামর্শ নিতেন। অনেক সময় তাঁদের যুক্তি ও আইনি ব্যাখ্যাই মেনে নিতেন। এত উদারতা দেখানোর কোনও দরকার ছিল? না হয় তাঁরা লেখাপড়া করেন, আইনটা বোঝেন, তাই বলে তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে? বিরোধীরা চূড়ান্ত সমালোচনা করলেও মাইকের তার খুলে নিতেন না। থামিয়ে দিতেন না। বরং নির্বিঘ্নে বলার সুযোগ করে দিতেন। শাসক দলের কেউ বাধা দিতে গেলেই ধমকে থামিয়ে দিতেন। কী অকৃতজ্ঞ, চিন্তা করুন। শাসক দল তোমাকে স্পিকার করল, তুমি কিনা তাদের থামিয়ে বিরোধীদের সুযোগ দিচ্ছো? এটা অকৃতজ্ঞতা নয়? শাসকরা চিৎকার করবে, ওয়েলে নেমে আসবে, বিরোধীদের ওপর হামলা করবে, মহিলা বিধায়কদের পেটাবে, গালাগাল দেবে, এটাই তো নিয়ম। উনি এসব কিছুই হতে দিতেন না।
৯) কোন কমিটিতে কে থাকবেন, সেটা সেই দল ঠিক করত। যেমন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে কে চেয়ারম্যান হবেন, বিরোধীরা ঠিক করত। তা কেন হবে? ওটা স্পিকার ঠিক করবেন। বিরোধীদের কে শাসক ঘনিষ্ঠ, সেটা দেখতে হবে না? কাকে ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল করতে হবে, সেটা বুঝতে হবে না? তাছাড়া পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির কাজ কী? সরকারের ভুল ধরা, হিসেব চেয়ে পাঠানো। বলুন তো, এমন কমিটির মাথায় বিরোধীদের বসানো যায়? আহাম্মক আর কাকে বলে?
১০ ) উনি নাকি কমনওয়েলথ পার্লামেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। বলরাম জাখর থেকে সাংমা, রবি রায় থেকে বালাযোগী, শিবরাজ পাটিল থেকে মনোহর যোশী, এমনকী সোমনাথ চ্যাটার্জি। যে যখন লোকসভার স্পিকার ছিলেন, সমস্যায় পড়লে তাঁর পরামর্শ নিতেন। আর তিনিও জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ পেয়ে জ্ঞান বিলি করতেন। জ্ঞান থাকলেই দিতে হবে? তার থেকে কিছু না জানা অনেক ভাল। কেউ পরামর্শ চাইবে না। বলুন তো, বিনে পয়সায় লোককে জ্ঞান দেবেন বলে কি তাঁকে স্পিকার করা হয়েছিল?
এরপরেও বলবেন, হাসিম আব্দুল হালিম একজন ভাল স্পিকার ছিলেন? আপনারা বলছেন বলুন। আমি বাপু বলতে পারছি না।