মানস পাত্র
শিক্ষা নিয়ে যাঁদের ন্যূনতম আগ্রহ নেই, তাঁরা যদি শিক্ষানীতি তৈরির ঠিকা নিয়ে নেন, তাহলে সত্যিই বড় মুশকিল। হঠাৎ হঠাৎ তাঁদের একরকম বাতিক হবে। অমনি দুম করে কিছু একটা ঘোষণা করে দেবেন। পরে এক সকালে অন্য কিছু মাথায় আসবে। দুম করে আগেরটা বাতিলও করে দেবেন। এই খামখেয়ালিপনা নিয়েই চলছে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। যেটা আজ ঘোষণা হচ্ছে, নিশ্চিত থাকতে পারেন তিন মাস পর সেটা হঠাৎ করেই বদলে যাবে।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক নিয়েও তেমনই ছেলেখেলা চলছে। হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারি–মার্চে। সেই সময় সবাই মেতে রইলেন ভোট নিয়ে। কারও কোনও মাথাব্যথাই নেই। নেতারা ভোট নিয়ে মেতে থাকুন, মিটিং–মিছিল করুন, জনসভা করুন। কিন্তু এই ছেলেগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুলিয়ে রাখার কোনও দরকার ছিল? ফেব্রুয়ারি–মার্চে পরিস্থিতি অনেকটাই ভাল ছিল। অনায়াসেই পরীক্ষা সেরে ফেলা যেত। তা না করে, একবার বলছেন জুলাইয়ে হবে, একবার বলছেন আগস্টে হবে। একবার শোনা যাচ্ছে, নাইনের নম্বরকেই মাধ্যমিকের নম্বর ধরা হবে। এখনও স্থির কোনও সিদ্ধান্তেই আসতে পারছে না সরকার।
আসলে, যাঁদের নিয়ে এইসব তথাকথিত কমিটি হচ্ছে, তাঁরা সবাই কলকাতার মানুষ। শাসকদলের আশেপাশে ঘুরঘুর করা মানুষ। শিক্ষা কাঠামোর সঙ্গে অনেকদিন এঁদের তেমন সম্পর্ক নেই। আর গ্রামীণ বা মফস্বলের স্কুল সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই। ফলে, তাঁরা যদি কোনও পরামর্শ দেন, তার সঙ্গে বাস্তবের তেমন যোগ থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
ধরা যাক, অনলাইন পরীক্ষা হল। অনলাইনে খাতা আপলোড করতে বলা হল। এটা হায়ার স্টাডিজের ক্ষেত্রে হলেও হতে পারে। কিন্তু মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে একেবারেই বেমানান। প্রথমত, সবার স্মার্টফোন থাকবে না। তার থেকেও যেটা বড় সমস্যা, ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে না তার টিউটার পরীক্ষা দিচ্ছে, বোঝা মুশকিল। কোথাও ছেলের পাশে বাবা–মা বসে যাবেন। তাঁরা উত্তর বলে দেবেন। আর কোথাও গৃহশিক্ষক ভাড়া করে আনা হবে। কার্যত তিনিই পরীক্ষা দেবেন। যার যেমন টাকা, তিনি তত দামী মাস্টার ভাড়া করে আনবেন। তাই অনলাইনে পরীক্ষার ভাবনা শুরুতেই ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা দরকার।
আমি একজন শিক্ষক। মফস্বলের স্কুলে শিক্ষকতা করি। আমার পরামর্শ, পরীক্ষা নিয়ে অহেতুক জট পাকাবেন না। সহজ একটা সমাধান সূত্র আছে। ছাত্ররা নিজের নিজের স্কুলেই পরীক্ষা দিক। অধিকাংশ ছাত্রই স্কুলের এক–দু কিলোমিটারের মধ্যেই থাকে। হেঁটে বা সাইকেল নিয়েই আসা যাওয়া করে। যাদের একটু দূরে বাড়ি, তারাও সাইকেল নিয়েই আসা যাওয়া করে। ফলে, যেমনভাবে স্কুলে আসত, তেমনভাবেই আসবে। অভিভাবকদের আসতে বারণ করা হোক। ক্লাস পরীক্ষায় যেমন অভিভাবকরা আসতেন না, ছাত্ররা নিজেরাই আসত, এক্ষেত্রেও সেরকমই করা হোক।
অন্যান্য ক্লাস তো বন্ধই থাকছে। ফলে, সেই রুমগুলো ফাঁকাই থাকছে। একটা স্কুলে ধরে নিলাম ১৫০ পরীক্ষার্থী। দশটা রুমে ভাগ করে দেওয়া যেতেই পারে। একেকটা রুমে থাকছে পনেরোজন করে পরীক্ষার্থী। সবার মুখেই মাস্ক থাকুক। একজন বেঞ্চের ডানদিকে। পেছনে যে বসবে, সে বেঞ্চের বাঁদিকে। এতে যথেষ্ট দূরত্বও থাকবে। এইভাবে পরীক্ষা আয়োজন করলে কোনও সমস্যাই থাকবে না। পরীক্ষার পর এক জায়গায় যেন জটলা না হয়, সেদিকেও একটু নজর রাখতে হবে।
খাতা কারা দেখবেন? খাতা যেমন জেলার সেন্টারে জমা হয়, তেমনি জমা হোক। অন্য জেলায় পাঠানোর দরকার নেই। জেলারই অন্য কোনও প্রান্তের স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পাঠানো যেতে পারে।
কেউ বলছেন, নাইনের বার্ষিক ও সেমেস্টারের নম্বরের গড় করতে। কেউ বলছেন অনলাইন পরীক্ষা নিতে। এগুলির কোনওটিই তেমন গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। তার থেকে নিজের স্কুলে পরীক্ষা নেওয়া অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত সমাধানা। দয়া করে, এত জট না পাকিয়ে এই সহজ পথটা বেছে নিন।
****