কুণাল দাশগুপ্ত
‘….আমার বুকের দূর্গে করে আক্রমণ ফ্যাসিস্ট দস্যুর মতো যক্ষাবীজ এসে, তবু আমি প্রাণপনে টেনে যাই শ্বাস, আমার বিশ্বাস রক্ত কণিকারা লাল ফৌজের মতো জয় সুনিশ্চিত, আবার দখল নিয়ে দেবে প্রত্যাঘাত….।’ সলিল চৌধুরি লিখেছিলেন। ওরাও লড়াই করছে। প্রাণের ভয়কে পকেটে পুরে। ওরাও লড়াই করছে সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতোই। ওরাও লাল ফৌজ। রেড ভলান্টিয়ার্স।
গত এক বছর ধরেই করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন বাম কর্মীরা। কমিউনিটি কিচেন করেছেন। শ্রমজীবী ক্যান্টিন করে মানুষের জন্য দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। গতবারের লকডাউনের সময় সাধারণ মানুষের বাড়ি চাল, ডালও পৌঁছে দিয়েছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র অবশ্য সুবিচার করেনি। বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা প্রকৃত অর্থেই সর্বহারা হয়ে গেছে। ভোটের অঙ্কে যাকে বলে ০/২৯৪। একটা আসনও জোটেনি। ডাহা ফেল। তবু মুহূর্তের জন্য থমকে যাননি সিপিআই(এম) কর্মীরা। ফল প্রকাশের পরের দিনই নেমে পড়েন সম্মুখ সমরে।
কোভিড তখন প্রবল পরাক্রমে মানুষের শরীর–মনকে তছনছ করতে শুরু করেছে। অতিমারীর ঘায়ে বেহাল বাংলা। ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। হাসপাতালে বেড নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই, পালস অক্সিমিটার নেই। অথচ জ্বর আছে, পজিটিভ রোগী আছে, আতঙ্ক আছে, সচেতনতার অভাব আছে। আর ভরসার ঠিকানা হয়ে আছে রেড ভলান্টিয়ার্স। দরকারের সময় সরকারের ভূমিকা পালন করলেন তাঁরাই। কী করলেন না তাঁরা? কেউ মাঝরাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুটছেন, কেউবা রোগী নিয়ে। পাড়ায় পাড়ায় স্যানিটাইজ করার কাজও করছেন লাল কর্মীরাই। পুরসভার কাজও করছে ওই শূন্য পাওয়া লাল বাহিনীই।
না, তাঁরা রঙ দেখছেন না, দল দেখছেন না। বামেদের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়নি বিজেপি থেকে তৃণমূল– কোনও দলই। ঢাক পিটিয়ে এসব কাজের প্রচার করতেও হয়নি। ছবি তুলতেও হয়নি। মুখে মুখে ফিরেছে এই পাশে থাকার কথা। লকডাউনে এঁদের জন্য কোনও ছাড়েরও ব্যবস্থা করেনি সরকার। তবু ওরা খাওয়া দাওয়া ফেলে বলছে, আপনাকে চলে যেতে দেব না। কারণ, ‘ওরা কাজ করে।’
ওঁদের কী আছে বলুন তো! ওঁদের কথা পুলিশ শুনবে না, হাসপাতাল শুনবে না, সরকারি অফিসাররাও শুনবে না। ঠিকাদারকে বললে টাকা বের করে দেবে, তাও নয়। ওঁরা যে নিজেদের পকেট থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা বের করতে পারবেন, এমন সামর্থ্যও ওঁদের নেই। তবু কী আশ্চর্য, এঁরাই কিনা হয়ে উঠলেন ভরসার ঠিকানা। মানুষ বিপদে পড়লে কাউন্সিলর, এমএলএ–কে ফোন না করে এঁদের ফোন করছেন! বিশাল বাজেট নিয়ে একটা আস্ত সরকার যা করে উঠতে পারছে না, এঁরা কিনা ফাঁকা হাতেই সেটা করে দেখাচ্ছে!
সরকারও মাঠে নামল। ঠিক করল, পাঁচ টাকায় খাবার তুলে দেবে। ঘটা করে প্রচার হল। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন হল। সেই বিজ্ঞাপনের বিনিময়ে কাগজে কাগজে মহিমাকীর্তন হল। সরকার নাকি মানুষের পাশে। দারুণভাবে ভোটে জেতাও হল। এই লড়াকু ছেলেগুলোকে শূন্যে নামিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, শপথ পর্ব ফুরোনোর আগেই একে একে প্রায় সব ‘মা ক্যান্টিন’ এর ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। অথচ, এই ছেলেগুলো ডাঁহা শূন্য পাওয়ার পরেও দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে লাফিয়ে পড়ল। কাঁধে কাঁধে আবার সেই অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিল, ওষুধ পৌঁছে দিল।
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, করোনা আছে, যাবতীয় অব্যবস্থা আছে, কিন্তু পাশে এই রেড ভলান্টিয়াররা নেই। লাল যোদ্ধারা নেই। মনটা যদি ছ্যাঁক করে না ওঠে, তাহলে বুঝবেন আপনি অসীম সাহসী।