দলবদলুরা যদি অজয় দে–‌কে দেখে কিছু শিখতেন!‌

অজয় দে কি নিছকই একজন প্রাক্তন বিধায়ক!‌ শুধুই শান্তিপুর পুরসভার দীর্ঘদিনের পুরপ্রধান!‌ এর বাইরেও অন্য এক অজয় দে আছেন। যিনি দলবদলের পর উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে নতুন করে জিতে আসার হিম্মৎ দেখিয়েছিলেন। গত দশ বছরে এমন নজির আর কটা আছে!‌ দলবদলুরা যদি অজয় দে–‌কে দেখে কিছু শিখতেন!‌ লিখেছেন রক্তিম মিত্র।

অজয় দে মারা গেলেন। এই করোনা আবহে একে একে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চলে যাওয়াটাও বিরাট অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়। পরের দিন কাগজে যা থাকে। বয়স হয়েছিল এত বছর। এত বছর বিধায়ক ছিলেন। এত বছর শান্তিপুর পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। জানা ছিল, এগুলোই থাকবে। হ্যাঁ, সেগুলোই ছিল। কিন্তু তার বাইরে আর দশজনের থেকে অজয় দে কোথায় আলাদা, কেন এই মূল্যবোধহীন রাজনীতির আবহে তিনি ব্যতিক্রম, সেটা উঠে এল না। আসার কথাও নয়। প্রথমত, জানলেও লেখা যাবে না। চাকে ঢিল ছোঁড়া হয়ে যাবে। তার বিপদ মারাত্মক। দ্বিতীয়ত, লিখতে গেলে তো জানতে হয়। সেই জানাতেও যে মস্ত ফাঁকি। বেঙ্গল টাইমসে বরং সেই অজয় দে–‌র দিকে একটু আলো ফেলা যাক।

ajay dey

দল ভাঙানোর খেলাটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। দিদিমণি ক্ষমতায় আসার পরেও সেটা কমেনি। বরং বহুগুন বেড়েছে। অন্য এক মাত্রা পেয়েছে। নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা। রাজ্যজুড়ে নিরঙ্কুশ দাপট। সরকার পড়ে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। তারপরেও অন্য দলের বিধায়কদের একের পর এক ভাঙিয়ে আনা হয়েছে। পতাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকী রাইটার্স বা নবান্নের মতো সরকারি জায়গা থেকেও চলেছ নির্লজ্জ দলবদল।

এই তালিকায় কত নাম, গুনতে গেলে নিশ্চিতভাবেই পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবে। তৃণমূলের পতাকা নিয়ে তাঁরা উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। তৃণমূলের সভায় গেছেন, বিধানসভায় তৃণমূলের বেঞ্চে গিয়ে বসেছেন। স্পিকার মশাইও দিব্যি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বসে থেকেছেন। দলত্যাগ বিরোধী আইন কার্যকর করতে চেয়ে বিরোধীরা চিঠি দিয়ে গেছেন। স্পিকার মশাই বেমালুম সেই চিঠি চেপে গেছেন। দলবদলুদের অনন্তকাল সময় দিয়ে গেছেন। এভাবেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

গত দশ বছরে রাজ্য রাজনীতিতে এটাই মোটামুটি নিয়ম। দলবদলু বিধায়করাও জেনে গেছেন, একদলের টিকিটে জিতে এসে অনায়াসেই অন্য দলে যাওয়া যায়। এতে কিছুই হয় না। ২০১১ থেকে ২০১৬, ২০১৬ থেকে ২০২১ –‌এই দুই টার্মে কজন বিধায়ক পদত্যাগ করে নতুন করে জিতে আসার নজির দেখিয়েছেন?‌ রাজনৈতিক পণ্ডিতরা অনেক খুঁজেও নামগুলো বলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। অথচ, খুব পুরনো ঘটনা তো নয়। গত দশ বছরের মধ্যেই এগুলো ঘটেছিল।

শুরু হয়েছিল কৃষ্ণেন্দু চৌধুরি আর হুমায়ুন কবীরকে দিয়ে। তাঁরা কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত। দিব্যি তৃণমূলের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ফেললেন। বিধায়ক পদ ছাড়তেই হত। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তৃণমূলের হয়ে উপ নির্বাচনে গেলেন। ইংরেজবাজার থেকে কৃষ্ণেন্দু জিতে এলেন, মন্ত্রী থেকে গেলেন। কিন্তু রেজিনগর থেকে হুমায়ুন হেরে গেলেন। পরের ধাপ। ২০১৩ তে রাজ্যসভা নির্বাচন। তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ফেললেন কংগ্রেসের সৌমিত্র খাঁ, ফরওয়ার্ড ব্লকের সুনীল মণ্ডল, আরএসপির দশরথ তিরকে ও অনন্তদেব অধিকারী। সৌমিত্র, দশরথ, সুনীলকে পুরস্কার হিসেবে লোকসভায় প্রার্থী করা হল। তাঁদের বিধায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়াতেই হত। ততদিনে আরও অনেকেই তৃণমূলে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। কেউ পদত্যাগের ধারেকাছেও যাচ্ছেন না। দিব্যি বিধায়ক থেকে গেলেন। এমন সময় অজয় দেও তৃণমূলে এসেছিলেন। তিনিও চাইলে অনায়াসেই তৃণমূল বিধায়ক হয়ে থেকে যেতে পারতেন। দুটো বছর নানা টালবাহানায় পেরিয়ে যেত। আর টালবাহানায় মদত দেওয়ার জন্য স্পিকার মশাই তো ছিলেনই। কিন্তু অজয় দে মানুষটা একটু অন্যরকম। তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি চাইলেন উপ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে নতুন করে মানুষের রায় নিয়ে আসবেন। আরও একজন ছিলেন সেই তালিকায়, ময়নাগুড়ির অনন্তদেব অধিকারী। এই দুজনেই নতুন করে উপনির্বাচনে জিতে এসেছিলেন।

২০১৬ তে দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূলের হয়ে। সেবার অবশ্য জোট প্রার্থী অরিন্দম ভট্টাচার্যের কাছে হারতে হয়েছিল। সেই অরিন্দম কংগ্রেসের হয়ে জিতে দিব্যি চলে গেলেন তৃণমূলে, পরে গেলেন বিজেপিতে। পদত্যাগের নামগন্ধ নেই। ১৬–‌২১ এই পাঁচ বছরেও অন্য দল থেকে তৃণমূলে যাওয়ার সংখ্যাটা অন্তত ২৫। কারণ, ততদিনে সবাই জেনে গেছেন মাথার ওপর এমন একজন স্পিকার আছেন, যাঁর সাহস নেই সদস্যপদ খারিজ করার। তাই অবলীলায় চলেছে দলবদল। তৃণমূলে যাওয়ার জন্য আর কাউকেই পদত্যাগ করতে হয়নি (‌কেউ কেউ লোকসভায় দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের কথা আলাদা, তাঁদের করতেই হত)‌।

এখানেই অজয় দে, অনন্তদেব অধিকারীরা আলাদা। তাঁরা অন্তত তৃণমূলে যোগ দিয়েই উপনির্বাচনে জিতে আসার হিম্মৎ দেখিয়েছিলেন। কই, বাকি দলবদলুরা তো এই সাহস দেখাতে পারলেন না।

বিভিন্ন চ্যানেল, বিভিন্ন কাগজের মৃত্যু সংবাদে এই অজয় দে–‌কে তো খুঁজে পেলাম না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.