স্বরূপ গোস্বামী
এ পথে আমি যে গেছি বারবার। সত্যিই, এই পথে তো কমবার যাইনি। কখনও ওঠার সময়। কখনও নামার সময়। দুপাশে পাইন গাছের সারি। দুদিকে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আকদিকে আলতো পাহাড়। অন্যদিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া চা–বাগান। কেমন একটা হালকা অন্ধকারের আবহ।
কিন্তু এখানে কখনও থাকা হয়নি। অবশ্য, এই রাস্তায় শেষবার গেছি বছর সাত–আট আগে। তখন এত হোম স্টের রমরমা ছিল না। মিরিকে অনেক হোটেল ছিল ঠিকই, কিন্তু ওই ঘিঞ্জি মিরিকে কখনই থাকার ইচ্ছে হয়নি। বরং, সুখিয়াপোখরি হয়ে আরেকটু গিয়ে লেপচা জগতে বেশ কয়েকবার থেকেছি। ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়াই যেন দারুণ এক রোমাঞ্চ। এক লহমায় সব বিরক্তি উধাও হয়ে যায়।
এবার আমাদের ঠিকানা ওকেটি। জায়গাটার নাম কয়েকদিনা আগেও জানতাম না। নেটে সার্চ করলে হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু নামটা জানলে তবে তো সার্চ করবেন। নামটাই যদি না শোনা থেকে যায়, তবে কীভাবে সার্চ করবেন? জায়গাটার সন্ধান দিয়েছিলেন তাবাকোশির বিজয় সুব্বা। প্রথমে তাঁর কাছেই উঠেছিলাম। এরপর কোথায় যাব, তাঁর ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আরও একটু উপরের দিকে, নেপাল বর্ডারের কাছে দারুণ একটা গ্রাম আছে। ওকেটি। ওখানে চলে যান। চারপাশে চা–বাগান আছে। ওয়েদার খুব ভাল। আর যে ছেলেটির কাছে পাঠাচ্ছি, সেই ছেলেটি আরও ভাল।
গাড়ি চলল মঞ্জোশীলা হোম স্টের দিকে। যাওয়ার রাস্তাটাই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। রাস্তার যে কোনও বাঁকে নেমে যাওয়া যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা যায়। মনে হবে, ক্যামেরার সব স্পেশ এখানেই শেষ করে দিই। এবার এল গোপালধারা টি এস্টেট। এর অবশ্য নাম শুনেছি। ড্রাইভার ভাই বলল, এটা একটা ভাল ভিউ পয়েন্ট। পরে এখানে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে আসবেন। দারুণ লাগবে। আমরা বললাম, এখন একটু ঘুরে নিলে হয় না! ড্রাইভার বলল, এখন নামলে এখান থেকে আর যেতে ইচ্ছে করবে না। ওদিকে দেরি হয়ে যাবে। পরে সময় নিয়ে ঘুরতে আসবেন।
পৌঁছে গেলাম মঞ্জোশীলা হোম স্টেতে। একমুখ হাসি নিয়ে আমাদের স্বাগত জানাতে হাজির মনোজ তামাং। সামনে ছড়ানো লন। কাঠের বেঞ্চ তৈরি করা। এখানে বসে শীতের রোদ গায়ে মাখার আনন্দই আলাদা। লন থেকে সামনের দিকে তাকালেই দিগন্ত বিস্তৃত চা–বাগান। এই চা–বাগানের চরিত্র অবশ্য একটু আলাদা। এটাকা চা–পাহাড়ও বলা যায়। অনেকগুলো ছোট ছোট পাহাড়। সবগুলো যেন একই সাইজের। সেই পাহাড়গুলো চারদিক থেকে চা–গাছ দিয়ে মোড়া। এমন হিসেব কষে, সাইজ মেপে পাহাড় তৈরি করা যায়! তাও প্রায় দেড়শো বছর আগে! ধন্য ইংরেজ জাতি। পাহাড়ে এলে এই জাতিটার প্রতি কেন জানি না শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। মনে হয়, এই জাতিটা আমাদের কাছ থেকে যা নিয়েছে, ফিরিয়ে দিয়েছে তার থেকে অনেক বেশি।
ঘরে ঢুকতেই আরও বিস্ময়। মেঝে থেকে শুরু করে সব দেওয়াল পাইন কাঠে মোড়া। পরতে পরতে শিল্পের ছোঁয়া। বাইরেই পাইন কাঠের গুঁড়িকে এমনভাবে টেবিলের আদল দেওয়া হয়েছে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠে যাওয়া যায়। সেখানেও চেয়ার টেবিল সাজানো। বেশ কয়েকটা বড় বড় জানালা, আর খোলা বারান্দা। যার যেদিকে মতি। কেউ চাইলে সেখানে বসে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারেন। কেউ আপনমনে গান ধরতে পারেন। কেউ ইচ্ছেমতো ফোনে বকবক করতে পারেন, কেউ সুরাপাত্র সাজিয়ে জমিয়ে বসতে পারেন। যা করবেন, কোনওটাই বেমানান মনে হবে না। রোদই উঠুক আর বৃষ্টিই পড়ুক, ভোর হোক বা সন্ধে, সবসময়ই মনে হবে এর চেয়ে ভাল জায়গা হয় না। বর্ষাকালে অনেকেই পাহাড়কে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এই ওকেটিতে যাঁরা আসবেন, বর্ষণমুখর দিনটা তাঁদের কাছে অন্য এক মাত্রা এনে দেবে। আপনিই তখন কালীদাস, মনে মনে আপনি তখন কত মেঘদূত লিখে ফেলেছেন। রবি ঠাকুর এখানে কয়েক মাস থাকলে শুধু বর্ষার গান দিয়েই গীতবিতান ভরিয়ে দিতে পারতেন। আমাদের সেই ক্ষমতা নেই। গুনগুন করে দু’চার লাইন গাইতে তো পারি।
কথায় বলে, আহার ছাড়া বিহার হয় না। এই বিহার অবশ্য নীতীশ কুমারের বিহার নয়, অভিধান ঘাটলে বিহারের একটা মানে হয় বেড়ানো। মনোজভাইয়ের স্ত্রী বিচিত্র সব পদ নিয়ে হাজির। বিচিত্র এক শাক, যা আমরা সমতলে পাই না। নামও শুনিনি। ব্রকোলি, ক্যাপসিকাম দিয়ে দারুণ এক তরকারি, স্যালাড, ভাজা, ডাল। সঙ্গে জিভে জল আনা ডিমের ঝোল। পাহাড়ের হোম স্টেতে মোটামুটি একটা অলিখিত নিয়ম আছে, দিনে ডিম, রাতে চিকেন। অন্যরকম চাইলে অবশ্য সে ব্যবস্থাও থাকে। বাইরে এলে ক্যালোরি মেপে খাওয়ার কোনও মানে হয় না। হাজার চেষ্টা করলেও বাড়িতে ফিরে ওই ডিমের ঝোল বানানো যাবে না। এটা এদের হাতের জাদু। এদের হাতেই ভাল মানায়। কাজেই খাবার টেবিলে একটা দিন না হয় একটু বেহিসেবি হলেন।
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে একটু গড়িয়ে নেওয়াই যায়। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে একটু পরেই বিকেল নেমে আসবে। আর পাহাড়ে সন্ধে নেমে আসে ঝুপ করে। তখন আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। তখন গৃহবন্দি হয়ে যে যার মতো করে বিনোদন খুঁজে নেয়। কেউ সিরিয়ালে, কেউ আড্ডায়, কেউ গানে, কেউ পানে। তাই দুপুরটা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কুঁড়েমি তো সারাজীবনের জন্য পড়ে রইল। এই রাস্তায় একটু পায়ে না হাঁটলে তো আসাই বৃথা। পায়ে পায়ে সেই গোলপাহাড়ের ভিউ পয়েন্টে। পাহাড়ের সেরা গন্তব্যগুলোর একটা তো বলাই যায়। চারপাশে পাহাড়ের সারি। নিচের সরু রাস্তা দিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন। ইচ্ছেমতো ছোট্ট পাহাড়গুলোয় উঠছেন। সেখান থেকে নিচটা কী চমৎকার দেখাচ্ছে! যে কোনও একটা পাহাড়ে উঠে মনে হবে, এখানেই কয়েক ঘণ্টা দিব্যি কাটিয়ে দিই। চা বাগান না চা–পাহাড় কী বলবেন, সেটা আপনার হাতে। যতদূর চোখ যাবে, শুধুই চা–গাছের ঢেউ। এমনই ব্যপ্তি, চাইলে চা–সমুদ্রও বলতে পারেন।
এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের মাঝে কোথাও পাইন গাছের সীমানা। সারি সারি সেই গাছ যেন সীমানা পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছের গা ঘেঁসে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে হারিয়ে যান। না, এর জন্য বিরাট কোনও কসরত করতে হবে না। অল্পবিস্তর ভুঁড়ি নিয়েও দিব্যি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে পারেন। নইলে, দুই পাহাড়ের মাঝখানের সমতল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। দু’দিকে চায়ের পাহাড়, মাঝখান দিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন। একটা গানের শুটিং করতে কেন যে বাংলা ফিল্মের লোকেরা অকারণে দূরদেশে পাড়ি দেয়। দুই পাহাড়ের মাঝে হেঁটে যাওয়ার এই দৃশ্যপট বিদেশের যে কোনও লোকেশনকে হাসতে হাসতে দশ গোল দিতে পারে। এতে প্রোডিউসারের খরচ বাঁচে, জায়গাটারও প্রচার হয়। কিন্তু এই সহজ কথাটা শুটিং পার্টিকে কে বোঝায়!
একটা জায়গায় গিয়ে অনেকের মন বসে না। চরকির মতো সাইট সিয়িং–এ বেরিয়ে পড়েন। গাড়িওয়ালাদের চক্করে পড়ে ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন পয়েন্ট ঘুরে আসেন। আমি অবশ্য কোনওকালেই এই পথের পথিক নই। বরং যে জায়গাটায় গেছি, সেটাই বেশি করে পায়ে হেঁটে দেখতে যাই। পুরীর আশপাশ দেখতে গিয়ে পুরীটাই কত লোকের দেখা হয়নি। সারা দিন নন্দন কাননের চিড়িয়াখানা দেখেই পথিক ক্লান্ত। ফিরে এসে সমুদ্রটাই বেচারার দেখা হল না। পরের দিন ছুটল অন্য ঠিকানায়। সন্ধেয় ফিরে যথারীতি ক্লান্ত। এভাবেই পুরীটা অদেখা থেকে যায়। দার্জিলিংয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ফাইভ পয়েন্ট, সেভেন পয়েন্টের চক্করে পড়ে পায়ে হেঁটে পর্যটকদের দার্জিলিংটাই ঘোরা হয় না। ঠিক তেমনি, গোলপাহাড়ের আশেপাশে ভাল জায়গার অভাব নেই। কিন্তু এটুকু মাথায় রাখুন, সেগুলো এই গোলপাহাড়ের চেয়ে বেশি সুন্দর নয়। তাহলে খামোখা অন্য দশ জায়গায় ছুটবেন কেন? যেখানে এসেছেন, সেখানটাই অলসভাবে ঘুরে দেখুন। তার রূপ, রস, গন্ধ পান করুন।
রাতে বেশ ভালই কাঁপুনি। বাইরে বসতে পারবেন না। এমনকী বারান্দায় খেতেও ইচ্ছে করবে না। মনে হবে, লেপের তলায় ঢুকে পড়ি। কিন্তু পাহাড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা। তার থেকে কিছুক্ষণ জেগে থেকে এই সুযোগে মোবাইলে কোনও সিনেমা দেখে ফেলুন। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন। জ্যোৎস্না রাত হলে তো কথাই নেই। সেই সবুজ আলোয় চায়ের পাহাড় যেন আরও সুন্দরী ও মোহময়ী হয়ে উঠবে। দূরের পাহাড়ে সারি সারি আলো। মনে হবে, রাতের তারাগুলো যেন মাটিতে নেমে এসেছে।
পাহাড়ের ভোর। সে এক অনাবিল আনন্দ। সাতসকালেই একমুখ হাসি নিয়ে হাজির মনোজ তামাং। বললেন, সামনের ওই পাহাড়টায় চলে যান। আজ ওয়েদার খুব ভাল। কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যাবে। চটপট বেরিয়ে পড়লাম সেই পাহাড়ের দিকে। আলো ফুটছে, তবে তখনও সূর্যের দেখা নেই। কোথায় সূর্যোদয়। কিছুটা যেন হাল ছেড়ে দিয়েছি। তখনই লন থেকে মনোজভাইয়ের চিৎকার ভেসে এল, আর মিনিট পাঁচেক দাড়ান। সূর্য উঠবে। সূর্যের প্রথম আলো গিয়ে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘায়। কথাটা হুবহু মিলে গেল। একটু পরেই সূর্যের আলো ঠিকরে এসে পড়ল সেই কাঞ্চনজঙ্ঘায়। অনেকটা রেঞ্জ যেন ধরা দিল আমাদের ক্যানভাসে। ক্ষণে ক্ষণে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার রং বদলে গেল। কখনও হালকা লাল, কখনও বাদামি, কখনও গোলাপি। অবশেষে সেই শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখের সামনে যা দেখছি, সব অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এভাবে পরতে পরতে কাঞ্চনজঙ্ঘার রং বদলে যায়!
যেটুকু অপূর্ণতা ছিল, এক লহমায় তা ঢেকে দিল ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বেলার দিকে মনোজভাইয়ের লন থেকেও ধরা দিল সেই শ্বেতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গ। তবে ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুভূতি পেতে গেলে চড়তে হবে সেই ছোট্ট পাহাড়ে। ছোট্ট সফরে আর কী চাই! প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেল প্রাপ্তি। একটাই আক্ষেপ, এত যে সফরটা এত ছোট হল! পরেরবার শুধু এখানেই আসব। অলসভাবে কাটিয়ে যাব কয়েকটা দিন।