যদি তিনি সত্যিই এমন শপথ নিতেন!‌

 

স্বরূপ গোস্বামী

শপথ নেওয়ার নির্দিষ্ট রীতি আছে। সেই রীতি মেনেই শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। কিন্তু ধরা যাক, এখানে রীতিটা একটু অন্যরকম। নিজের ভুল অকপটে স্বীকার করা, শুধরে নেওয়ার অঙ্গিকার করা। আজকের দিনে যদি এমন শপথ তিনি নিতেন।

প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যে ভাষায় প্রচার করেছি, সেটা একজন মুখ্যমন্ত্রীকে মানায় না। কেন্দ্রের সমালোচনা হতেই পারে। আগের মুখ্যমন্ত্রীরাও করেছেন। আমিও করেছি। কিন্তু যে ভাষায় প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করেছি, সেটা একেবারেই উচিত হয়নি। ভোট পেরিয়ে গেছে। এখন আর সেগুলো মনে রাখতে চাই না।

অনেক বড় মার্জিনে এবার জিতেছি। আগের থেকেও বেশি মানুষের সমর্থন নিয়ে সরকারে এসেছি। প্রথম কাজ শান্তি বজায় রাখা। হ্যাঁ, আমি সবার মুখ্যমন্ত্রী। যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও। যাঁরা দেননি, তাঁদেরও। আগে নতুন ছিলাম। না জানার কারণে, কখনওবা জেদের বশে অনেক ভুল করেছি। কাছে ঘুরঘুর করা ভুলভাল লোকের পরামর্শে ভুল কাজ করেছি। এই দশটা বছর আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। প্রথম কাজ, রাজ্যে শান্তি বজায় রাখা। কিন্তু ভোটের পর যা হচ্ছে, আমি সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন। এই হামলা বন্ধ হওয়া দরকার। মুখে বলেছি, হিংসা চাই না। কিন্তু কর্মীরা শুনছে না। ভাবছে, মুখে বলতে হয়, বলছি। আমি হয়ত শান্তি চাই না, প্রতিহিংসা চাই। যেভাবেই হোক, এই ভাবমূর্তি বদলাতে হবে। আপনারা আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।

১) পুলিশের মেরুদন্ড সত্যিই ভেঙে পড়েছে। আগেও পুলিশ শাসক দলের নির্দেশ মেনে কাজ করত। অনেক সময় গ্রামের মানুষ সুবিচার পায়নি। ভেবেছিলাম, মানুষকে সুবিচার দেব। কিন্তু হল উল্টোটা। গত দশ বছরে, আমি পুলিশমন্ত্রী থাকাকালীন পুলিশের নৈতিকতা, মেরুদন্ড বলে কিছুই নেই। আমার দলের ব্লক নেতারা, পাড়ার নেতারা যা চেয়েছে, পুলিশ তাই করেছে। বিরোধীরা আক্রান্ত হয়েছে, ঘরছাড়া হয়েছে। পুলিশ কিছুই করেনি। পুলিশ জানত, কিছু করতে গেলে আমি রেগে যেতে পারি। তাই হাত গুটিয়ে বসেছিল। কেউ কেউ ‘অতি সক্রিয়’। যারা আক্রান্ত, তাদেরকেই মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে ভরে দিয়েছে। যে অফিসার যখন কাজ করতে চেয়েছে, আমি কাজ করতে দিইনি। বুঝিয়ে দিয়েছি, আমি আইনের শাসন চাই না। আমি যা চাই, সেটাই আইন।
শুধু তাই নয়, একের পর এক কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। পুলিশ সেই প্রমাণ লোপাট করেছে। পঞ্চায়েত, পুরসভা নির্বাচনে পুলিশের সামনেই গুন্ডামি ও বুথদখল হয়েছে। পুলিশ নির্বিকার থেকেছে, কারণ আমরা তাই চেয়েছিলাম।
এবার নির্বাচন কমিশন আমার প্রিয় পুলিশদের সরিয়ে দিল। কেউ কেউ ভাল কাজ করতে চাইল। আমি জিতেই পুরানো অফিসারদের আবার ফিরিয়ে আনলাম। যারা নির্ভীকভাবে কাজ করেছিল, তাদের কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দিলাম। কথা দিচ্ছি, এসব আর হবে না। পুলিশ দলদাস নয়, পুলিশের যা করা উচিত, তাই করবে। আমি থানায় আসামী ছাড়াতে গেলেও ছাড়বে না। যাঁরা প্রমাণ লোপাট করবে, তারা নয়। যে এস পিরা হাফ প্যান্ট পরে দলের হয়ে টাকা তুলবে, তারাও নয়। যারা কয়লা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাও নয়। যে পুলিশ মাথা উঁচু রেখে কাজ করবে, তারাই আমার প্রিয় পাত্র হবে।

bidhan sabha

২)‌ এবার গোটা প্রচারে একজনের নামে নানা অভিযোগ শুনতে হয়েছে। কয়লা, বালি, গরু–‌নানা বিষয়ে তার নাম জড়িয়ে গেছে। সবটাই তো আর অপপ্রচার হতে পারে না। আগেও জানতাম না, এমন নয়। এবার কড়া হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার নাম ভাঙিয়ে যে যা খুশি করে যাবে, এটা চলতে পারে না। দলটা আমার হাতের তৈরি। কেউ মাতব্বরি করবে, এটা আর সহ্য করব না।

৩)‌ এবার ভোটে একটি ছেলে বেশ ভাল ভূমিকা নিয়েছে। হ্যাঁ, প্রশান্ত কিশোক। লোকসভা ভোটে যখন বিপর্যয়ের মুখে পড়লাম, তখন ও এসে অনেকটাই হাল ধরল। কোথায় কোথায় ফাঁকফোকর ছিল, সেটা খুঁজে বের করল। কিছু মেরামতও করল। কিছু নতুন নতুন পরিকল্পনা নিল। যেগুলো কাজে এসেছে। আমি ওকে অনেকটাই স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। কিন্তু সব কাজ মেনে নিতে পারিনি। যেমন, বিরোধী দলের অনেককে ও ভাঙিয়ে আনতে চাইল। যাকে–‌তাকে মন্ত্রী করার প্রস্তাব দিল। তখন আমিও ঠিক বুঝিনি। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা আছে। কিন্তু এবার ও সরকারে নাক গলাতে চাইবে। ওকে এবার বলব, তুমি এসো। আর তোমার দরকার নেই। আর আমার ভাড়াটে সৈন্য লাগবে না। আমারক কাজটা এবার আমাকেই করতে দাও।

৪) বিধানসভাকে আমি কখনই গুরুত্ব দিইনি। একসময় আমারই উপস্থিতিতে বিধানসভায় ভাঙচুর চালিয়েছিল আমার দলের বিধায়করা। আজ বুঝতে পারি, চরম অন্যায় করেছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও বিরোধী বিধায়কদের প্রশ্নের উত্তর দিইনি। শুরুতেই বলেছিলাম, বিরোধীরা দশ বছর মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে চুপ করে থাকুক। আমি বললে যা হয়! আমার দলের লোকেরা ওদের কথা বলতেই দেয়নি। কেউ বলতে উঠলেই হল্লা করেছে। এমন সভার জন্য যেমন ব্যক্তিত্বহীন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার দরকার, ঠিক তেমনই নিয়োগ করেছিলাম। আমার হাতে থাকা দপ্তরগুলো নিয়ে প্রায় আলোচনাই হয়নি। আমার দপ্তরের অধিকাংশ বাজেটই গিলোটিনে পাঠানো হয়েছে। এবার আর তা হবে না। বিধানসভায় বিরোধীদের অধিকার থাকবে। স্পিকার স্পিকারের মতোই কাজ করবেন। আমি সব প্রশ্নের উত্তর দেব। বিরোধী কোনও তরুণ সদস্য যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা করলে তাঁকে ‘দেখে নেব’ বলে হুমকি দেব না। কাছে ডেকে পিঠ চাপড়ে দেব।
৫) অন্য দল থেকে ভাঙিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা রেকর্ড করেছি। আমি নিজে ভাঙাতে যাইনি। এর জন্য এক্সপার্ট লোক আছে। যেখানে একজনও সদস্য নেই, সেখানেও অনায়াসে জেলা পরিষদ দখল করেছি। সিপিএম, আর এস পি, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস – যেখান থেকে যে এসেছে, পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল করা হয়েছে। এবার বাম বা কংগ্রেসের কেউ নেই। বিরোধী বলতে বিজেপি। আমার দল ছেড়ে যাওয়া কেউ কেউ ওই দলের বিধায়ক হয়ে এসেছে। চাইলেই ভাঙাতে পারি। কিন্তু আর না। যা আসন পেয়েছি, তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। বিরোধীদের মর্যাদা দেব। নিজেরা অনেক আসন পেয়েছি। বিরোধীদের ভাঙাতে যাব কেন?

৬) স্বাস্থ্য। এটাও আমার হাতেই ছিল। কিন্তু নানা বিষয়ে ব্যস্ত থাকায় এই দপ্তরে সময় দিতেই পারিনি। কোভিড পরিস্থিতি আরও ঠান্ডা মাথায়, আরও ভালভাবে সামাল দেওয়া যেত। অহেতুক সংখ্যা গোপন করতে চেয়েছি। রাস্তায় গোল গোল দাগ কেটেছি। রোজ দেড় দু ঘণ্টার প্রেস কনফারেন্স করেছি। এতে প্রচার হয়েছে, ছবি হয়েছে, লাইভ টেলিকাস্টও হয়েছে। কিন্তু এতখানি হ্যাংলামি মুখ্যমন্ত্রীকে মানায় না। কই, কেরল বা ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর তো রোজ কাগজে ছবি বেরোয়নি। টিভিতে তারা ভাষণও দেয়নি। আড়াল থেকেই কাজ করেছে। তারা পারলে আমি পারব না?‌ সবাই যেন অক্সিজেন পায়। হাসপাতালে বেড পায়। মৃত্যুর সংখ্যা যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনেক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল করেছি। বিরোধীরা বলত, শুধু বিল্ডিং হয়েছে, চিকিৎসা পরিষেবা গড়ে ওঠেনি। ঠিকই বলত। কোভিড সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এবার ওই হাসপাতালগুলোকে আরও কার্যকর করে তুলতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যে বেশি করে জোর দিতে হবে। আর নিজে নয়, এবার যিনি স্বাস্থ্য বোঝেন, সময় দিতে পারবেন, সামাল দিতে পারবেন, এমন কাউকেই এই দপ্তরটা দিতে হবে। পূর্ণসময়ের একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী দরদার। দশ বছরে এটুকু অন্তত বুঝেছি।

mamata5

৭) শিল্প। যতই শিল্প সম্মেলন করি, ভাষণে যাই বলি, স্বীকার করে নেওয়া ভাল, গত দশ বছরে শিল্পে তেমন অগ্রগতি হয়নি। বড় কারখানা হয়নি। কর্মসংস্থান হয়নি। তেলেভাজা, চপ, বড়ি দেওয়া- এসবকেই শিল্প বলে চালিয়েছি। লোক হাসিয়েছি। শিল্পপতিরা এসেছেন। ভাল ভাল কথা বলেছেন। কোনও ব্যাটাই বড় অঙ্কের লগ্নি করেনি। আমি ল্যান্ড ব্যাঙ্ক করেছি। কেউ ভরসা করেনি। আসল সমস্যা জমি। বুঝেও বুঝিনি। সিঙ্গুরে টাটাকে তাড়িয়ে ভুল করেছিলাম। তার খেসারত দিয়েছি। ভুল স্বীকার করে নতুন করে শুরু করতে পারতাম। কিন্তু ভুল আবার কী স্বীকার করব? পুরানো ভুলকেই জেদের বশে আঁকড়ে থেকেছি। যে বিনিয়োগ করতে এসেছে, আমার দলের স্থানীয় লোকজন এমন তোলাবাজি করেছে, পাততাড়ি গুটিয়ে সব পালিয়েছে। শিল্পপতিরা সমস্যার কথা বলেছেন। গুরুত্ব দিইনি। এবার শিল্পের ব্যাপারে সত্যিই উদ্যোগী হতে হবে। নইলে বেকার ছেলেরা যাবে কোথায় ? অনেক ভুল হয়েছে, আর নয়। সিঙ্গুরে টাটাকেই ডেকে আনব। বলব, খুলুন গাড়ি কারখানা, দেখি কে বাধা দেয়। আর যেন কেউ মমতা ব্যানার্জি হয়ে হাইওয়ে অবরোধ না করতে পারে। আর যেন কোনও টাটাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হয়।

৮) কাগজ বা টিভিতেও গণতন্ত্র রাখিনি। যারা আমার বিরুদ্ধে কিছু লিখতে গেছে, সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছি। বলেছি, ওমুক কাগজ পড়বেন না। ওমুক চ্যানেল দেখবেন না। কেউ সমালোচনা করলে বলেছি, কুৎসা। তাকে ভেবেছি সিপিএম বা বিজেপি-র এজেন্ট। কোন চ্যানেলে কে সিইও হবে, কোথায় কে সম্পাদক হবে, কার চাকরি থাকবে না, আমি ঠিক করে দিয়েছি। এবার আর তা হবে না। সবাই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবে। ভোটের আগে বিজেপির মদতে রাতারাতি গোটা দুই চ্যানেল গজিয়ে উঠল। দিনরাত আমার সমালোচনা করত। আমি চাই, তাদের যেন পাততাড়ি না গোটাতে হয়। তারা নির্ভয়ে সমালোচনা করুক। সেই সমালোচনা থেকেও আমাকে শিক্ষা নিতে হবে।

৯) আমার সভা বা মিছিল মানেই তারকার ছড়াছড়ি। অনেককে এম এল এ, এম পি বানিয়ে দিয়েছি। বাকিদের মধ্যেও লোভটা ঢুকিয়ে দিয়েছি। এবারও সেই পথেই হেঁটেছি। মিটিংয়ে আমাকে ডাকতে হয় না। লোক আছে। তারাই হোয়াটসঅ্যাপে ডাকে। না এলে কী কী হতে পারে, সেটা শিল্পীরা জানে। তাই ভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, সবাই আসে। কে কোন সিনেমায় কাজ করবে, কে করবে না, কোন পরিচালক আউটডোরে কাকে নিয়ে যাবে, সিন্ডিকেট ঠিক করে দেয়। নাটক! সেখানে আমার বিরুদ্ধে কিছু থাকলে সে অ্যাকাডেমিতে শো পাবে না। না, এগুলো আমাকে করতে হয়নি। এগুলো যারা দেখভাল করে, তারা জানে, আমি কী চাই। অভিনেতা, পরিচালক, গায়ক, নাট্যকার- কেউই প্রাণ খুলে কথা বলতে পারে না। যা হয়েছে, হয়েছে। কথা দিলাম, এই অবস্থা বদলানোর চেষ্টা করব। আমার বা সরকারের বিরোধীতা করা নাটকও অ্যাকাডেমিতে চলতে পারবে। সরকারের সমালোচনা থাকবে, এমন সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকাবে না। নন্দনে সেইসব ছবি দিব্যি চলবে। আমি নিজেও দেখতে যাব। ভাল হলে পিঠ চাপড়ে দিয়ে আসব।

১০) খেলা। এখানেও মেরুদন্ডহীনদের ছড়াছড়ি। ওদের মধ্যেও লোভ ঢুকিয়ে দিয়েছি। মিটিংয়ে এলেই খেলগুরু, খেলরত্ন, নানা সুযোগ সুবিধে। তাই আমার মিছিলে ওরাও চলে আসে। নাইট জিতলে ইডেনে সংবর্ধনা দিই, আই এস এলে অ্যাটলেটিকো জিতলেও তাই। কে সি এ বি-র সভাপতি হবে, আমিই ঠিক করে দিই। বলেছিলাম, সব জেলায় স্টেডিয়াম করে দেব। কাজের কাজ হয়নি। গ্রামের খেলাধূলার উন্নতি হয়নি। আমার দাদা আর ভাই প্রায় সব খেলাতেই ছড়ি ঘোরায়। আমি জানি। কিন্তু ওদের আটকাইনি। ক্লাবে ক্লাবে টাকা দিয়েছি। খেলার উন্নতি কিছুই হয়নি। কী হয়েছে, সবাই জানে। ওরাই তো ভোটে খেটেছে। এবার আর তা করব না। এবার খেলাকে তার মতো করেই বিকশিত হতে দিতে হবে। লোভ বা ভয় দেখানো নয়, খেলার মাঠেও প্রাণ ফিরে আসুক।

১১) অর্থ। মন্ত্রী বেশ যোগ্যই ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বাধীনতা ছিল না। আমি যা চাই, তাই তাঁকে করতে হয়েছে। দু টাকার চাল থেকে কন্যাশ্রী, ক্লাবের অনুদান থেকে ইমাম ভাতা- সবকিছুই তাঁকে ব্যবস্থা করতে হয়। হয়ত তিনিও চাইতেন না। কিন্তু আমি যে চাইতাম। তাই করতে হয়। বেশি রাজস্ব আসছে আবগারি থেকে। এমনি এমনি তো রাজস্ব বাড়েনি। এই রাজস্ব বাড়াতে গিয়ে ঘরে ঘরে মাতাল তৈরি করতে হয়েছে। পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। মেয়েদের উপর অত্যাচার বেড়েছে। আমি আনন্দে মশগুল থেকেছি আমার রাজস্ব বেড়েছে বলে। আর সেই পথে হাঁটব না। রাজস্ব কমে, কমুক। মদে নিয়ন্ত্রণ আনতেই হবে, নইলে রাজ্যের সর্বনাশ। পাশের রাজ্যে নীতীশ কুমার পেরেছে, আমি পারব না? পারতেই হবে।

১২) শিক্ষা। এখানেও চূড়ান্ত দলতন্ত্র। আগেও ছিল। আমাদের সরকার আসার পর চক্ষুলজ্জাটুকুও নেই্। অধ্যক্ষ মার খাচ্ছেন। উপাচার্য ঘেরাও থাকছেন। মাস্টারদের ডিএ দিতে পারিনি। ওদের সিপিএমের এজেন্ট মনে করেছি, তাই দিইনি। ভর্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ, সব ব্যাপারেই চূড়ান্ত দুর্নীতি। এসএসসি, প্রাইমারি ঠিকঠাক নিতে পারিনি। জেলায় জেলায় আট লাখ, দশ লাখ দর উঠেছে। টাকা দিলেই চাকরি হবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। চাকরিও হচ্ছে না, টাকা আদায় করাও যাচ্ছে না। সৎভাবে, যোগ্যতার নিরিখে যে চাকরি হতে পারে, এটা কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না। দলের অনুগত লোকদেরই বিভিন্ন কমিশনে বসানো আছে। কৃতী ছাত্রদের হাতে আমার লেখা কথাঞ্জলি তুলে দিয়েছি। সেখান থেকে প্রেরণা নিতে বলেছি। বুঝিনি, সেগুলো পড়ে ওই ছাত্ররা হাসতে পারে। এমন লোককে শিক্ষামন্ত্রী করেছি, যে দপ্তরটা বোঝেই না। আমার পিএইচডি হল না। আর নিজে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে, ক্ষমতা দেখিয়ে পি এইচ ডি করে ফেলল। যে রিসার্চ গাইড, তাকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে উপাচার্য করে দিল। এমন নজির সারা দেশে নেই। আমার রাজ্যে আছে। আর এসব চলতে দেওয়া যাবে না। যথার্থ গুণী মানুষকেই শিক্ষামন্ত্রী করতে হবে। তিনি যেন দপ্তরটাকে ঠিকঠাক চালাতে পারেন। তিনি যেন আমাকে খুশি করতে গিয়ে সিলেবাসে আমার জীবনী না ঢুকিয়ে ফেলেন। পাঠ্যবইয়ের শুরুতেই যেন আমার কথা না লিখতে হয়।

১৩) মন্ত্রীসভা। এটা বড় বেশি কলকাতা কেন্দ্রিক। সব গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরই কলকাতার লোকেদের হাতে। এমমকী কৃষি, ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত–‌এইসব দপ্তরগুলোও কলকাতার লোকেদের হাতে। জেলার বিধায়করা একেবারেই উপেক্ষিত। এবার এটা বদলাতে হবে। আরও কত দপ্তর আছে। কত ভুল আছে। কত অঙ্গিকার আছে। রবি ঠাকুর লিখেছিলেন চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির। আমার রাজ্যে ভয়শূন্য বলে কিছু নেই, উন্নত শিরও আমি পছন্দ করি না। দলের লোক দলের ভেতরে সুপরামর্শ দিলে তাঁকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি। মন্ত্রীরা অবশ্যই আমার নির্দেশ মানবেন। কিন্তু কোথাও আমার ভুল হলে, বা তাঁর মাথায় নতুন কোনও পরিকল্পনা এলে যেন নির্ভয়ে বলতে পারেন। দলের মধ্যেও একা আমি বলব বাকি সবাই শুনবে, এমনটা যেন আর না হয়। সবাই বলুক, আমি বরং একদিন শুনব।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.