অন্তরা চৌধুরি
গল্প হোক উপন্যাস, সিনেমা হোক বা সিরিয়াল; গল্পের মুখ্য চরিত্রকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততেই হয়। সারাজীবন ধরে সেই নায়ক বা নায়িকা অনেক লড়াই করবে। লড়াই করবে নিজের সঙ্গে। এই সমাজের সঙ্গে। অনেক চাওয়া আর না পাওয়ার দ্বন্দ্বের সঙ্গে। জোর করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরণপণ সংগ্রাম করবে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তার জীবন তরী স্রোতের বিপরীতে একটু একটু করে এগিয়ে যাবে।
তারপর! …। একদিন নতুন সূর্য উঠবে। তার উজ্জ্বল আলোর ছটায় সমস্ত অন্ধকারের অবসান হবে। রথের চাকা জীবনের কক্ষপথে ঘুরবে। সেদিন আবার সেই আপ্তবাক্য প্রমাণিত হবে ‘ভগবান সবাইকেই একবার সুযোগ দেন।’ কেউ তার সদ্ব্যবহার করে, কেউ করে না। আর সেই না করার তালিকায় রয়েছে ‘পত্রিকায়’ প্রকাশিত প্রচেত
গুপ্তের ‘নিষাদ’ উপন্যাসের নায়ক স্বয়ং নিষাদ।
নিষাদ কোনও কল্পলোকের নায়ক নয়। আমার আপনার মতোই অগণিত মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এক তরুণ। যার দু চোখে খুব বড় মাপের স্বপ্ন হয়ত ছিল না। তবু শিক্ষা অনুযায়ী আটপৌরে এক জীবনের খোঁজেই সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটি পাড়ি দিয়েছিল কলকাতা মহানগরীতে। বাবা মারা যাওয়ার পর আরও অনেকের মতো আসলে সেও ভেবেছিল কলকাতায় পড়াশোনা করলেই বুঝি চাকরি পাওয়া যায়। তাই মা আর বোনকে ফেলে নিষাদ চলে আসে কলকাতায়। সাদামাটা পড়াশোনা শেষে ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি অর্জন করে সে চেয়েছিল একটা সাধারণ চাকরি। কিন্তু সেটাও যে এত দুর্মূল্য, কে জানত!
মনে পড়ে যাচ্ছে এই লেখকেরই ‘সাগর’ চরিত্রটির কথা। বাংলা সাহিত্যে চরিত্রটি বেশ পরিচিত। সেও নিরেট বেকার। আপাতভাবে হেরে যাওয়া এক যুবক। কিন্তু তার সঙ্গে নিষাদের এক মস্ত ফারাক। সাগর চাকরি বা তথাকথিত জীবনের নিরাপত্তায় বিশ্বাস করে না। সে কোনও বাঁধনে নিজেকে বাঁধতেও চায় না। তাই মেয়েরা তার প্রেমে পড়তে চাইলেও সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। বলা যায়, প্রচলিত সিস্টেমকেই সে বুড়ো আঙুল দেখায়। কিন্তু নিষাদ তো তেমন নয়। সে একটা নিরাপদ চাকরি চায়, সে ঘর বাঁধতেও চায়। সাগর যদি মাপা হাসি হয়, তবে নিষাদ যেন চাপা কান্না।
আসলে, কমন ম্যানের কোনও মূল্য নেই আমাদের সমাজে। হয় গুটিকয়েক ভাল ছেলে মেয়ের বৃত্তে ঢুকে তরতর করে এগিয়ে যাও। নইলে, চাই বড় মাপের যোগাযোগ। কোনও ক্যাটাগরিতেই পড়ে না নিষাদ। তাই বারবার ঠোক্কর খাওয়াই যেন তার ভবিতব্য। দাঁতে দাঁত চেপে আপ্রাণ চেষ্টা করে এই মহানগরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। সে লাজুক–বিনয়ী, অথচ ভেতরে ভেতরে প্রখর আত্মসম্মান বোধ। তার পরিচয়ের বৃত্তে দেখা যায় ঐশানী রায়, অপূর্ব রায়, মেঘপর্ণা, প্রেস মালিক ও বন্ধু পলাশকে। একেক চরিত্র একেকভাবে ধরা দিয়েছে। পরতে পরতে এসেছে নানা বাঁক। চরিত্রগুলো একথায় সাদা বা কালো নয়। বরং, কিছুটা ধুসর। ঐশানীর মাধ্যমে অপূর্ব রায়ের কোম্পানিতে চাকরি হতে হতেও হয় না। মেঘপর্ণার সঙ্গে প্রেমজ বিয়ে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠে না। কারণ যার চাকরি নেই, মাথা গোঁজার ঠাইঁ নেই, তেমন পাত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা মানে আজীবন দুঃখ ও দারিদ্রকে বরণ করা। একজন শিক্ষিতা আধুনিকার পক্ষে এর চেয়ে মারাত্মক ভুল আর কী হতে পারে! আসলে কিছু মানুষকে সারাজীবন ধরেই নিজস্ব একটা যন্ত্রণার ভাষা খুঁজে ফিরতে হয়। নিষাদও তাদের একজন। তাই হয়ত কেউ কেউ তাকে বিষাদ বলে ডাকে। মজা করে নাকি উপহাস করে, কে জানে!
উপন্যাসে নানা উপকাহিনি এসে ভিড় করেছে। গ্রাম জীবন, শহর জীবন সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে। একদিকে যেমন নিষাদের শহুরে জীবনের লড়াই আছে, অন্যদিকে গ্রামে তার বোন সিন্ধুরার সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কথাও আছে। ঘুরে ফিরে এসেছে প্রয়াত বাবার কথাও। উপন্যাসের আঙ্গিকে বারবার ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতি ও চেতনাপ্রবাহ রীতিকে অনুসরণ করেছেন লেখক। উপন্যাস পড়তে পড়তে নিষাদের জীবন যুদ্ধ কখন যেন আমাদের জীবনযুদ্ধ হয়ে যায়। জীবনের অনিবার্য বিপন্নতাকেই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন লেখক। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে এসে ভোজবাজির মতো সবকিছু ঠিক হয়ে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে, এত যন্ত্রণার পর উপন্যাসের নায়ক নিষাদ ঠিক জিতে যাবে।
তাই জীবনের কাছে কার্যত হার স্বীকার করে নেওয়া এক তরুণের জীবনে যখন এক এক করে সব স্বপ্নপূরণের হাতছানি আসে; যখন বন্ধ দরজাগুলো এক এক করে খুলতে থাকে, তখনই তার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এই সমাজে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। আর সেই গিভ অ্যান্ড টেক–এক রীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে মহানগরী ত্যাগ করে ফিরে আসে নিজের জায়গায়। আসলে, কলকাতা এমন এক শহর যে সবাইকে গ্রহণ করে না। এখানে এসে কেউ প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ এমন অতলে তলিয়ে যায় যার হদিশ কেউ পায় না। তাই সপূর্ণ রূপে হারিয়ে যাওয়ার আগেই নিষাদ ফিরে যায়। নিষাদ উপন্যাসের নায়ক হলেও আমাদের সমাজে অতিমাত্রায় বাস্তব এক রক্ত মাংসের মানুষ। রক্ত মাংসের মানুষ বলেই সব হারানোর পরেও নিঃস্ব রিক্ত নিষাদ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে।
‘ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে।’ নিষাদ সেই মাঝখানে দাঁড়ানো এক ‘কমন ম্যান’ যে সমস্ত আপাত–ব্যর্থতার মধ্যেও শিয়রে স্বপ্নের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখতে পারে, স্বপ্ন দেখার শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, ‘পারতে হবে, আমাকে পারতেই হবে।’ আর এখানেই উপন্যাসটি শুধু একটি কাহিনির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনযন্ত্রণার এক সকরুণ আলেখ্য।