ময়ূখ নস্কর
হরিহর ল্যাপটপ খুলিয়া অফিসের বকেয়া কাজ শেষ করিতেছিল- এমন সময় সর্বজয়া অপুকে লইয়া গিয়া বলিল, ওগো ছেলেটাকে একটু ধরো না?…ধরো দিকি একটু! হরিহর বলে- উঁহু, ওসব গোলমাল এখন এখানে নিয়ে এসো না, বড় ব্যস্ত। সর্বজয়া রাগিয়া ছেলেকে ফেলিয়া রাখিয়া চলিয়া যায়।
খোকা মাত্র দুইটি কথা বলিতে শিখিয়াছে। মনে সুখ থাকিলে মুখে বলে জে-জে-জে-জে এবং দুধে-দাঁত বাহির করিয়া হাসে। মনে দুঃখ হইলে বলে, না-না-না-না।
হরিহর কাজ করিতে করিতে হঠাৎ দেখে ছেলে তাহার মোবাইলটা মুখে লইয়া চুষিতেছে। হরিহর ফোনখানা কাড়িয়া লইয়া বলে, আঃ, দ্যাখো, বাধিয়ে গেল এক কাণ্ড, আমি আছি একটা কাজ নিয়ে!
হঠাৎ একটা চড়ুই পাখি আসিয়া হরিহরের ফ্ল্যাটের একফালি বারান্দায় বসে। শহরে চড়ুই পাখি আজকাল দুর্লভ। খোকা বাবার মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া সেদিকে দেখাইয়া হাত নাড়িয়া বলে- জে-জে-জে-জে-
হরিহরের বিরক্তি দূর হইয়া গিয়া ভারি মমতা হইল।
অনেক দিন আগের কথা তাহার মনে পড়িল। তখন হরিহর নিজেই অপু ছিল। আর তাহার বাবা ছিলেন হরিহর।
…………………………………
কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর অপু (আজকের হরিহর) বিছানায় শুইয়া ছিল। খেলা বন্ধ, তাই গৃহবন্দি হইয়া বোর হইতেছিল। তাহার বাবা অফিস হইতে ফিরিয়া একটা প্যাকেট তাহার হাতে দিয়া বলিলেন- দ্যাখো তো খোকা, কি বল দেখি?
অপু তাড়াতাড়ি বিছানার উপর উঠিয়া বসিল; উৎসাহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল- নতুন বই? না বাবা?
অপু তখনও একা একা বই কিনিতে শেখে নাই। কলেজ স্ট্রিট তাহার কাছে রাজপুতানার মরুপর্বত কি দিল্লি-আগ্রার রংমহলের মতোই দূরদিগন্তের কোনও অজানা দেশ। তাহার বাবাই তাহার জন্য বই কিনিয়া আনে।
অপু বাবার হাত হইতে তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা লইয়া দেখিল- বড় বড় অক্ষরে ‘পথের পাঁচালি’ কথাটা লেখা। সে বলিল, এটা কি ছোটদের বই বাবা?
তাহার বাবা জানিতেন না। তিনি কখনও সম্পূর্ণ পথের পাঁচালি পড়েন নাই। কিন্তু স্কুলের সিলেবাসের বাহিরেও যাহা কিছু শিখিবার আছে ছেলেকে তাহা শিখাইবার জন্য তাঁহার একটা অদম্য অপ্রশমনীয় পিপাসা।
তখনকার বাবারা এমনটাই ছিলেন। তাহারা ভাবিতেন, এই বই তাহার সন্তানকে অপরের দুঃখে চোখের জল ফেলিতে শিখাইবে, মার্কশিটের নম্বরের মূল্য কি ইহার চাইতেও বেশি?
তখনকার বিদ্যালয়গুলিও ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। সেখানে প্রসন্ন গুরুমশাইদের সন্ধান মিলিত। যাঁহারা শাসনের সময় দণ্ডপাণি হইলেও, শ্রুতিলিখনের সময়, ‘জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরির’ বর্ণনা শুনাইয়া, পড়ুয়াদের কচি কর্ণে মহামধুর কুহকের সৃষ্টি করিতেন, নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরণীর সহিত তাহাদের পরিচয় করাইয়া দিতেন।
তখনকার খোকা খুকিরাও অন্য প্রকারের ছিল। ভিডিও গেমস না খেলিয়া তাহারা কুঠির মাঠে নীলকণ্ঠ পাখি দেখিতে যাইত, তাহাদের বাবা তাহাদের লইয়া যাইতেন, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হইয়া তাহারা রাজু রায়ের ন্যায় আষাঢ়ুর হাটে তামাকের দোকান খুলিতে চাহিত।
তখন তাহারা নির্জন দুপুরে, মায়ের পাশে শুইয়া চাঁদের পাহাড় পড়িত। যাহারা পড়িতে শেখে নাই, তাহাদের মায়েরা দিদি নাম্বার ওয়ান না দেখিয়া সন্তানকে পড়িয়া পড়িয়া শোনাইতেন।
অনন্ত কালপ্রবাহের সহিত পাল্লা দিতে গিয়া সেইসব দিন কুটার মতো, ঢেউয়ের ফেনার মতো ভাসিয়া গিয়াছে। ইছামতির চলোর্মিচঞ্চল স্বচ্ছ জলধারা কচুরিপানার দামে মজিয়া গিয়াছে। সিলেবাসের অন্ধকূপে মুখ ঢাকিয়া পথের পাঁচালির নির্বাচিত অংশ বাধ্যতামূলক হইয়াছে। পরীক্ষার নোট মুখস্থ করিতে করিতে আজকের অপুরা ক্রমে হরিহর হইয়া ওঠে।
নোট মুখস্থ করিতে করিতে রাত্রি গভীর হয়। হেমন্তের আঁচ লাগা শিশিরার্দ্র নৈশ বায়ুর প্রবেশ রোধ করিয়া এসি-র বাতাসে ভরিয়া যায় তাহাদের বেডরুম। সভ্যতার চোখ-ধাঁধানো, অশোভন আলোয় কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের ম্লান জ্যোৎস্না আপন অস্তিত্ব হারাইয়া ফেলে। আলো আঁধারের অপরূপ মায়ায় পূর্ণ যে রাত ঘুমন্ত পরীর দেশের মত রহস্যে ভরা, তাহা অপুদের অগোচরেই থাকিয়া যায়।
তবুও এক এক দিন এমন সময় অপুর ঘুম ভাঙিয়া যায়। শনশন করিয়া হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া ড্রয়িং রুমের সৌখিন পর্দা উড়াইয়া বহিয়া যায়। কোথা হইতে ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস ভাসিয়া আসে। অপুর মনে হয়, সেই কবি যেন আসিয়াছেন, ঔপন্যাসিক নন কবি, পথের কবি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অপুরা তাহাকে ভুলিতে বসিলেও, তিনি কিন্তু অপুদের ভোলেন নাই। হরিহরদের ভোলেন নাই। প্রয়াণের ৫৫ বছর পরেও তিনি তাহাদের সোনাডাঙার মাঠে, মধুখালির বিলে, ধলচিতের খেয়াঘাটে, সলতেখাগি তলায় লইয়া যান। মাঝেরপাড়া স্টেশনে লইয়া যান। লোকজন, তামাকের গাঁট, হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকা হিরু গাড়োয়ান, সকলকে পিছনে ফেলে যে রেলগাড়ি বাহিরের উলুখড়ের মাঠ চিরিয়া ছুটিয়া গিয়াছিল, তাহাকে তিনি আবার মাঝেরপাড়া স্টেশনে ফিরাইয়া আনেন। বালক পুত্রের হাত ধরিয়া যুবক অপু আবার নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া আসে।
হরিহর ঘুম ভাঙিয়া ওঠে। ল্যাপটপ ফেলিয়া ওঠে।
মোবাইল লইয়া ক্রীড়ারত নিজের সন্তানের চোখের দিকে তাকাইয়া নিজের প্রতিচ্ছবি দেখিতে পায়। মনে পড়িয়া যায় অমল শৈশবের কথা, তাহার নিজস্ব এক নিশ্চিন্দিপুরের কথা।
আজ কতদিন সে সেই নিশ্চিন্দিপুর দেখে নাই! কতকাল!
হঠাৎ সে কাঁদিয়া আকুল হয়। উচ্ছ্বসিত চোখের জল ঝর-ঝর করিয়া তাহার কপোল ভাসাইয়া দেয়, চোখ মুছিয়া হাত উঠাইয়া আকুল সুরে মনে মনে বলে- আমার যেন নিশ্চিন্দিপুরে ফেরা হয়, আমার সন্তান যেন নিশ্চিন্দিপুরে যেতে পারে – হে বিভূতিভূষণ- তুমি এই কোরো, আমাদের ঠিক যেন নিশ্চিন্দিপুরে যাওয়া হয়-পায়ে পড়ি তোমার-
পথের কবি প্রসন্ন হাসেন। কোনও কথা না বলিয়া হাত তুলিয়া তাহাকে আহবান জানান, ধুলো পড়া বইয়ের তাকের দিকে। ইছামতীর দিকে, আরন্যকের দিকে, চাঁদের পাহাড়ের দিকে, মিসমিদের কবচের দিকে… পথের পাঁচালির দিকে…
হরিহর ল্যাপটপ বন্ধ করিয়া, অপুকে লইয়া সেইদিকে এগিয়ে যায়।