মোয়ার সেকাল একাল

মোয়া মানেই উঠে আসে জয়নগরের নাম। দুটোই যেন সমার্থক। কিন্তু মোয়ার আসল রাজধানী মোটেই জয়নগর নয়। এই জয়নগর ব্র্যান্ডের আড়ালেই হারিয়ে গেছে বহরু। যাই যাই শীতের আমেজে সেই জয়নগর আর বহরু থেকে ঘুরে এলেন সংহিতা বারুই।

যাই যাই শীতের সময়। তবু মাঝে মাঝেই সে ফিরে আসছে। আর তাই এখনও ভেসে আসছে সেই চেনা ডাক,  মোয়া চাই মোয়া, জয়নগরের মোয়া, মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার স্মৃতি । শীত এলেই এই মোয়াওলারা চলে আসত  সুদূর জয়নগর থেকে । শীত মানেই বনভোজন, নূতন গুড়, সন্দেশ, রসগোল্লা , আর কত কী ? মোয়া মানে জয়নগরের  কথা মনে আসে । জয়নগরের মোয়া মানে একটা ব্র্যান্ড।  আর ব্র্যান্ড হলে তা তো নকল হবেই । তাই যেখানে  যা মোয়া তৈরি হচ্ছে সবই জয়নগরের নাম দিয়ে দিব্যি বিক্রি হচ্ছে। দোকানে নামী দামি  প্যাকেটে যা বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশ  মোয়াই কিন্তু জয়নগরের নয় ।

khejur gachh2

অন্তত এমনই দাবি করেছেন মোয়া শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ব্যবসায়ীরা । কিন্তু কী আছে জয়নগরে, যা অন্য মোয়ায় নেই ? সেটা জানতে ও বুঝতেই পাড়ি দিয়ে ছিলাম জয়নগর ।  ওখানে পৌঁছানোর পরে  যেটা সবার আগে নজর কাড়বে,  তা হল  রাস্তার দু’ধারে সারি সারি মোয়ার দোকান।  ছোট ছোট দোকান যেমন আছে, বড় দোকানও আছে ,  আছে হকারদের ব্যস্ততা।  ট্রেন স্টেশনে এলেই শুরু হয়ে যায় ছোটাছুটি । জয়নগর  নামটার সঙ্গে মোয়ার নামও জড়িয়ে আছে ,  তাই ট্রেনে যাওয়ার পথে এক মিনিটের বিরতিতেও অনেকে মোয়া কিনে ফেলেন।

ষ্টেশন জুড়ে  বিক্রিও হয় ভালই। স্টেশন ছাড়িয়ে একটু বাজারের দিকে যাওয়া যাক। শুরুতেই গেলাম “কমলা সুইটসে”। এটাই সবথেকে  নামজাদা দোকান। বেশ বড় দোকান।  শুধু মোয়া আর নলেন গুড়ের সন্দেশ। দেশের  নানা প্রান্তে যেমন যায় , তেমনি বরাত আসে  বিদেশ থেকেও। দূরদর্শনে মাঝে মাঝেই একটি তথ্য চিত্র দেখে  থাকবেন। “রিসার্চ অফ মোয়া” ।  শীতকালে  মাঝে মাঝেই সেটি চালানো হয় । এই দোকানের কথা হয়তো সেখানে  দেখেও  থাকবেন। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের দোকান।  আপাতত দোকানের  সামলাচ্ছেন  অরিন্দম চ্যাটার্জি।

moya6

নিশ্চয় মোয়ার পাহাড় জমে আছে ! একেবারেই না। অরিন্দমবাবু  জানালেন, ” আমরা পাইকারি ব্যবসা করি না। আগে থেকে তৈরিও রাখি না । যখন যেমন  অর্ডার আসে ,  তখন সেরকম ভাবে তৈরি করে দেওয়া হয় । শীত যত জাঁকিয়ে বসে, মোয়ার বিক্রিও  তত বেড়ে যায়। সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় দোকানের কর্মীদের । তাঁর দাবি, জয়নগরের মোয়া বলে বাজারে যেসব বিক্রি হয়, তার অনেক মোয়াই জয়নগরে তৈরি নয়।’

আবার জয়নগরে তৈরি হলেই সেটা দারুন মানের হবে, এমনও নয়। এই নামটা ব্যবহার  করেই অনেক দোকান চলছে। সেগুলোর মধ্যে মোয়ার আসল স্বাদ পাবেন না। তাহলে  জয়নগরের মোয়ায় কী আছে, যা অন্য জায়গার মোয়ায় নেই?  জানা গেল , মোয়া তৈরির মূল উপাদান হল  কনকচূড়  ধানের খই। এই ধান একমাত্র এই  এলাকাতেই হয়। অন্য ধানের খইয়ে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না । শুরুতেই এরকম একটা ফারাক তৈরি হয়ে যায় । এরপর আসুন গুড়ের কথায়। এই  এলাকার খেজুর  গাছগুলোর মধ্যেও একটা বিশেষত্ব আছে। গাছ থকে ভোর রাতে রস নেওয়ার পর তিনদিন রাখা হয়। তারপর তাকে জাল দেওয়া হয়। সেখানে থেকে তৈরি হয় গুড় । এই গুড়ের একটা আলাদা স্বাদ। অরিন্দমবাবুর দাবি, অন্য জায়গায় যে খই ও গুড়  ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে ভাল মোয়া হয় না। কেমন একটা  মাদকের গন্ধ পাওয়া যায়।

কাছেই এক আত্মীয়র বাড়িতে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই দোকানের মোয়া খেয়ে  প্রেমে পড়ে গেলেন। মোয়া খেয়ে গেলেন ও নিয়ে গেলেন বাড়ির জন্য । এবার যাওয়া  যাক খোকনের দোকানে । এই দোকান অবশ্য অনেক পুরনো। মোয়ার ইতিহাস আর  খোকনের দোকানের ইতিহাস প্রায় সমসাময়িক । ১১৫ বছরের পুরনো দোকান ।

খোকনবাবু অবশ্য বেঁচে নেই । দোকানের মালকিন সন্ধ্যা কয়ালের দাবি , “আমাদের দোকানটাই এখনকার সবচেয়ে পুরনো দোকান । এই দোকানের মোয়া খেয়ে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী।”কী ভাবে এই মোয়া তৈরি হয়?  সন্ধ্যাদেবীর দাবি,  “আমরা এলাকার  চাষীদের থেকে কনকচূড় ধান কিনি। আর নিজেরা গুড় তৈরি করি । চেষ্টা করি, গুনগত মান যেন বজায় থাকে। আমরা  কোনও পাইকারি ব্যবসা করি না। অনেকদিনের পুরনো দোকান ।  সুনামের জন্যই লোকে আসেন। আমরা চেষ্টা করি সেই সুনাম ধরে রাখতে। এবার গেলাম আশীর্বাদ সুইটসে। দেখা হল ৭২ বছরের প্রবীণ আইয়ুব  মোল্লার  সঙ্গে । দীর্ঘ দিন ধরে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। দোকানের বিক্রিবাটাও ভালই ।

moya7

কিন্তু মোয়াকে ঘিরে চারিদিকে যা চলছে, তাতে বেশ হতাশ এই প্রবীণ দোকানি,  “অধিকাংশ দোকানদার  জানে না কীভাবে মোয়া বানাতে হয়। ওরা চিনি আর বাতাসা দিয়ে দিয়ে মোয়া করে । চাষের সময় রাসায়নিক ব্যবহার করে । ফলে, ধানের সেই স্বাদ থাকে না । মাঠের আলের ধারেই খেজুর গাছ। ওই  রাসায়নিকের প্রভাব খেজুর গাছের ওপরই পড়ে । রসের সেই স্বাদও নেই ।  সবমিলিয়ে আগের সেই মোয়া আর নেই। অথচ, জয়নগরের মোয়ার নামে  তা বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে। আগে থেকে বেশি করে  রাখবেন , তারও উপায় নেই।  বেশিদিন থাকেনা। নষ্ট হয়ে যায়।”

মোবাইল রিচার্জ করুন। আকর্ষণীয় অফার। ক্লিক করুন।
মোবাইল রিচার্জ করুন। আকর্ষণীয় অফার। ক্লিক করুন।

চুপি চুপি একটা তথ্য তাহলে জানিয়ে রাখি । মোয়ার আসল রাজধানী কিন্তু জয়নগর নয় । শিয়ালদা থেকে যাওয়ার পথে আরও দুটো স্টপেজ আগে, “বহরুতে”। কিন্তু কে আর চেনে বহরুকে ? তাছাড়া, সেটা তো জয়নগর থানার মধ্যেই। বেচারা বহরু। আলাদা পরিচিতি  পেয়ে সেও হারিয়ে গেছে জয়নগরের মোড়কে। সেই মোয়াও বিক্রি হচ্ছে জয়নগরের মোয়া নাম নিয়েই । একটা ব্র্যান্ড একবার তৈরি হয়ে গেলে সেই  স্রোতে আনেক কিছুই হারিয়ে যায় । বহরুও হয়তো তেমনি  হারিয়ে গেছে জয়নগরের আড়ালে।


Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.