ফিরে এসো, প্রিয় ডাবল ডেকার

শ্যামল আচার্য

বয়স বাড়লে মানুষ ক্রমশ অতীতমুখী হয়ে ওঠে। ষাট পেরোনোর পর এই অতীতের টানটা বোধ হয় আরও বেড়ে যায়। যখন কর্মব্যস্ততা থাকে না। স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অফুরন্ত অবসর।
আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে অনেকটাই জড়িয়ে আছে ডাবল ডেকার বাস। যতবার এই বাসে চেপেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকারণে। ছোটবেলায় তখন কীই বা এমন কাজ!‌ এখনকার ছেলেদের মতো তিন–‌সাড়ে তিন বছরে স্কুল যেতে হত না। ওয়ান হতে না হতেই তিন–‌চারটে করে টিউশনিও ছিল না। বাবা–‌মায়ের সেই নাছোড়বান্দা ফার্স্ট হওয়ার আবদারও ছিল না। আমরা বেড়ে উঠেছি কিছুটা আপন খেয়ালে। ইচ্ছে মতো ঘুরতাম, খেলতাম।
তখন ফাইভ বা সিক্স। পাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে একটু দূরে যাওয়ার হাতছানি। হেদুয়ার ওপর দিয়ে পেরিয়ে যেত একটা দোতলা বাস। একদিন দুই বন্ধুর ইচ্ছে হল, চেপে বসব। কোথাও না কোথাও তো একটা পৌঁছব। চেপে গেলাম। কোথায় নেমেছিলাম, জানি না। সেই বাসেই আবার ফিরেও এসেছিলাম। কন্ডাক্টার কাকু আবার হেদুয়াতেই নামিয়ে দিয়েছিল। ভাড়াও নেয়নি।

double decker
সেই নেশা ধরে গেল। পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একেবারে সামনের দিকে চলে যেতাম। রবিবার ছুটি, ফলে সেদিন কোনও তাড়া নেই। অধিকাংশ রবিবারেই দোতলা বাসে কোথাও না কোথাও হারিয়ে যেতাম। বন্ধু বদলে যেত। বেশ কয়েকবার একা একাও গেছি। বাসের লোকেরাও কেমন চেনা জানা হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই কলকাতাকে চিনতে শেখা। কোথায় কোন সিনেমা হল, কোন দোকানটা কোথায়, কোন কলেজটা কোথায়, ওপর থেকে স্পষ্ট বোঝা যেত। এই চেনাটা পরে নানাভাবে কাজে লেগেছে।
সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই একসময় এই নেশা কেটে গেল। কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাছাড়া, তখন যে বয়স, তাতে ওইধরনের ছেলেমানুষী আর মানায় না। তবু কোথাও যাওয়ার সুযোগ এলে, সেই রুটে যদি ডাবল ডেকার থাকত, চেপে যেতাম, অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তবু শৈশবের সেই রোমাঞ্চটা যেন ফিরে পেতাম। নয়ের দশকের পরেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। একটু একটু করে রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেল আমার কৈশোরের সাথী।

double decker2

বছর দুই আগেও শুনেছিলাম, আমার প্রিয় শহরে আবার ফিরে আসছে সেই ডাবল ডেকার। বেশ উল্লসিত হয়েছিলাম। কিন্তু কোথায়!‌ প্রতিশ্রুতি ভোলার ব্যাপারে সরকারের জুড়ি নেই। নানা কাজের ভিড়ে আবার হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন। আবার শিরোনামে উঠে এলে ডাবল ডেকার। কলকাতার রাস্তায় নাকি আবার দেখা যাবে সেই বাস। লালের পরিবর্তে নিশ্চিতভাবেই রঙটা নীল সাদা হয়ে যাবে। তা হোক। এখন অবসর। বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখতে মন্দ লাগে না। সেই সঙ্গে মনে মনে ভাবি, আগে এখানে কী ছিল। ষাট পেরোনো নস্টালজিয়া নিয়ে আবার খুঁজতে বেরোবো। ফিরে আসুক সেই ডাবল ডেকার। আবার সেই উদ্দেশ্যহীনভাবে না হয় বাসে উঠে পড়ব। ষাটোর্ধ্ব চোখ দিয়ে আবার খুঁজব আমার হারানো কলকাতাকে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.