নিজেদের অহেতুক হাস্যকর করছেন রেলকর্তারা

নির্মল দত্ত

কতকাল আগে কবি নজরুল লিখে গিয়েছিলেন, ‘‌মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ, মাটির মালিক তাঁহারাই হন।’‌

আমাদের রেলকর্তা আর প্রশাসনের লোকেদের দেখলে তেমনটাই মনে হয়। তাঁরাই রেল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। অথচ, বাস্তবের মাটি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসবাস করেন।

কলকাতা ও শহরতলিতে লোকাল ট্রেন চালু হবে কিনা, তা নিয়ে কয়েকদিন ধরেই নানা বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন, চালানো উচিত নয়। কেউ বলছেন, চালানো উচিত। কেউ বলছেন, চলুক, তবে অল্প। সব মতের পক্ষেই কিছু না কিছু যুক্তি আছে।

train4

কিন্তু ট্রেন চললে কী হবে, সে সম্পর্কে রেল কর্তাদের কোনও ধারণা আছে বলে মনে হচ্ছে না। করোনা কতটা ছড়াবে, সে অন্য বিষয়। কিন্তু সতর্কতার নামে আজগুবি সব নিয়মের কথা শোনানো হচ্ছে। লোকাল ট্রেনে তিনজনের সিটে নাকি দুজনকে বসতে হবে। মাঝের সিট খালি রাখতে হবে।

কথাটা শুনতে বেশ ভাল। বেশ একটা সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের ব্যাপার আছে। কিন্তু বাস্তবে কতখানি গাঁজাখুরি, তা যাঁদের সামান্যতম অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন। এইসব কর্তারা কখনও লোকাল ট্রেনে চড়েছেন বলে মনে হয় না। তাঁদের একবার বনগাঁ লোকাল, লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে চাপিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে তাঁরা বুঝতে পারবেন, দক্ষিণ শহরতলির লোকাল ট্রেনের চেহারা কেমন।

তিনজনের সিটে দুজন!‌ সকাল বা সন্ধেবেলায় এইসব ট্রেনে বসা তো দূরের কথা, ঠিকঠাক দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অনেকে দুটো পা–‌ও রাখতে পারেন না। এক পায়ে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অনেককে ডান্ডা ধরে দরজার বাইরে কার্যত ঝুলে ঝুলে যেতে হয়। সেখানে মাঝের সিট ফাঁকা রাখার ফরমান!‌ প্রভু যিশু যেন এই অর্বাচীনদের ক্ষমা করেন।

প্ল্যাটফর্মে চলছে গোল দাগ কাটার পর্ব। এই দাগে নাকি যাত্রীরা অপেক্ষা করবেন। ট্রেন এলে তারপর ধীরে–‌সুস্থে উঠবেন। এটাও দেখতে বেশ ভাল। এই নিয়ম রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেসের ক্ষেত্রে চলতে পারে। গেদে লোকাল বা বনগাঁ লোকালে চলে না। একটা ট্রেন ঢুকলে মুহূর্তে কত যাত্রী নেমে আসেন, কত যাত্রী ট্রেনে ওঠেন, কীভাবে হুড়োহুড়ি করে নামা–‌ওঠা করতে হয়, সেই ধারণা থাকলে এই গোল দাগ কাটার প্রহসন মঞ্চস্থ হত না।

train3

তাই বলে কি নিয়ম থাকবে না?‌ সতর্কতা থাকবে না। রাজধানী বা দুরন্ত এক্সপ্রেসে এই সতর্কতার তবু একটা মানে আছে। সেখানে অনেকে হয়ত নিয়ম মানবেন। কেউ কেউ হয়ত মানবেন না। সেখানে আরপিএফ দিয়ে তবু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। নিয়ম মানানো যাবে। পুরোপুরি না হলেও নব্বই ভাগ হয়ত নির্দেশ মানানো সম্ভব। কিন্তু শিয়ালদা শহরতলির লোকালে এক শতাংশও সম্ভব নয়। সেই পরিকাঠামোই রেলের নেই। সেই যাত্রী সচেতনতা তৈরিই করা যাবে না। তাই, এই সব ট্রেনের ক্ষেত্রে তিনজনে সিটে দুজন বসার ফরমান বা গোল দাগ কাটা ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। রেলকেই হাস্যকর হতে হয়।

যে নিয়ম এক শতাংশও মানানো যাবে না, সেই নিয়ম নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করাই ভাল। সেই নিয়ম কাগজে–‌কলমে থাকুক, ঘটা করে প্রচার করে নিজেদের হাস্যকর না করাই ভাল।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.