বেঙ্গল টাইমস প্রতিবেদন
লকডাউনে অনেকেই ঘরবন্দি। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। অনেকেই কাজ হারানোর মুখে। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঢালাও কর্মী ছাঁটাই করছে।
কিন্তু কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা এই কঠিন সময়ে আরও বেশি করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করছেন। সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কারও হাতে তুলে দিয়েছেন জামাকাপড়। কারও হাতে চাল–আলু। আবার শীত আসার আগেই কারও হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে শীত বস্ত্র।
সারা বাংলাজুড়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে এসেছে। গত ছ সাত মাসে এমন অনেক ছবি কাগজে ছাপাও হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, শুরু করেন, কিন্তু মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেন। কয়েকদিন হয়ত ঘটা করে বিলি হয়েছে, তারপর তাঁদের আর দেখা নেই। কিন্তু মাসের পর মাস এই পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছে ভর্গো হেল্পিং ফ্যামিলি।
শুরুটা হয়েছিল একেবারেই সাদামাটাভাবে। শিক্ষক রাজা মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী রুমেলি মুখোপাধ্যায়। শি৭কতার পাশাপাশি দুজনেই রেইকি চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত। জাপানি এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে শুধু স্পর্শের মাধ্যমেই অনেক রোগ নিরাময় সম্ভব। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে আছে ছাত্ররা। কেউ কেউ বিদেশেও এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে সাড়া ফেলেছেন। রাজা ও রুমেলি দুজনেই গ্র্যান্ডমাস্টার। নিজেদের মতো করে বিভিন্ন দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছিলেন। যাঁরা অভাবী মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছিলেন, সেইসব প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করছিলেন। কিন্তু একটা সময় মনে হল, আমরা তো নিজেদের উদ্যোগেই কিছু করতে পারি। এগিয়ে এল ভর্গো হেল্পিং ফ্যামিলি। গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করতে গিয়ে অনেকেই ভর্গো, দেবশ্য, ধীময়ী উচ্চাচরণ করে থাকেন। সংস্কৃত এই শব্দের মানে আলো। এই অন্ধকার সময়ে তাঁরাও এগিয়ে এলেন আলোর দিশারী হয়ে।
তৈরি হল দেশের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রদের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। নানা জায়গা থেকে টুকটাক সাহায্য আসতে লাগল। তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন রাজা–রুমেলি। সঙ্গ দিলেন সম্রাট নন্দী, সুজাতা দে, সোমা ব্যানার্জির মতো উদ্যমীরা। ছোট ছোট উদ্যোগে কতটা করা সম্ভব, নিজেরাই ঠিক করে নিলেন। কখনও ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত চা–বাগান এলাকায় কম্বল বিতরণ। কখনও মেদিনীপুরের পাওসি অনাথ আশ্রমে, কখনও নৈহাটির বৃদ্ধাশ্রমে বস্ত্র বিতরণ। কখনও বর্ধমানের ফুডিজ সংস্থার পাশে দাঁড়িয়ে খাদ্য বিতরণ। আবার কখনও পুরুলিয়ায় শবরদের গ্রামের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। লোকাল ট্রেন চলছে না। কীভাবে দিন কাটছে হকারদের? সেই বিষয়টাও ভাবিয়েছিল ভার্গোর কর্তাদের। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়িয়েছেন হকারদের পাশেও।
নানা জায়গা থেকে ডাক আসছে। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক তো থাকেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও সব ডাকে হয়ত সাড়া দেওয়া যাচ্ছে না। মনে হল, এভাবে সবাইকে তো সাহায্য করা সম্ভব নয়। তার চেয়ে যদি সেই পিছিয়ে থাকা মানুষদের রোজগারের নতুন দিশা দেখানো যায়! যদি তাঁদের সাবলম্বী করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যায়! কিন্তু গ্রামের গরিব মানুষের পুঁজি কোথায়? তাঁদের পক্ষে বিনিয়োগ করাও সম্ভব নয়। তাছাড়া, যে পণ্য উৎপন্ন হবে, তার বিপণনের ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। মাশরুম চাষের ভাবনা নিয়ে এগিয়ে এল ভার্গো। কথা হল বেশ কিছু মাশরুম ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও। তাঁরা বীজ, সার দেবেন। গ্রামের মানুষ সেই মাশরুম চাষ করবেন। বিক্রি নিয়ে তাঁদের ভাবতে হবে না। বাজার দরে সেই মাশরুম কিনে নেওয়ার আশ্বাসও থাকছে। কোনও বিনিয়োগ নেই। জমিও লাগছে না। সেইসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের এনে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। লোকসানের ভয়ও নেই। মহাজনের ঋণ শোধ করার চাপও নেই। ভর্গোর অন্যতম প্রাণপুরুষ রাজা মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘দিনের পর দিন হাত পেতে নিতে কারও ভাল লাগে না। তাছাড়া, আমরাও হয়ত চিরদিন সাহায্য করতে পারব না। তার থেকে ওঁদের যদি সাবলম্বী করতে পারি, সেটা অনেক বড় ব্যাপার। ওঁরা সহজেই মাশরুম চাষ করে সাবলম্বী হতে পারবেন। বিক্রির ব্যাপারটা নিয়ে ওঁদের কোনও দুশ্চিন্তা থাকছে না। আমরাই সেটা সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দেব। পরে ওঁরা নিজেরাই মার্কেটিংয়ের ব্যাপারটা শিখে যাবেন। তখন আমাদের না থাকলেও চলবে।’
এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে ভর্গো। এগিয়ে চলেছেন রাজা–রুমেলিরা। নিজেদের পেশাগত ব্যস্ততার বাইরেও সময় বের করে পাশে দাঁড়াচ্ছেন দুর্গতদের। এই আকালেও কেউ কেউ স্বপ্ন দেখান। কেউ কেউ আলো দেখান। তাই অন্ধকার পথের শেষে কোথাও একটা আলোর দিশা ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়।