দীপাবলি এলেই বেজে ওঠে তাঁর গান। আবার যেন জীবন্ত হয়ে ওঠেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। কেন শ্যামাসঙ্গীতকেই বেছে নিলেন? কোন অবসাদে নিজেকে নিয়ে গেলেন আত্মহননের পথে? তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়েই বেঙ্গল টাইমসের ফিচার।লিখেছেন দিব্যেন্দু দে।
ঠিক বাহান্ন বছর। হ্যাঁ, ঠিক বাহান্ন বছর আগেই তিনি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন।কালীপুজো এলেই বড় বেশি করে তাঁর কথা মনে পড়ে। তাঁর গাওয়া গানগুলো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, বাড়িতে বাড়িতে বেজে ওঠে। কার কথা বলছি ? অনেকেই ধরে ফেলেছেন-পান্নালাল ভট্টাচার্য। আমাদের অনেকেরই বেড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর গান।
আমার জন্ম আটের দশকে। বাড়িতে যে খুব একটা ভক্তির পরিবেশ ছিল, এমনও নয়। নতুন টেপ রেকর্ডার এলে যা হয়! যার যেমন পছন্দ, সে তেমন ক্যাসেট কিনে আনে। পান্নালাল ভট্টাচার্যের ক্যাসেটটা কে কিনে এনেছিল, আজ আর মনে নেই। হতে পারে ছোট কাকা।
আমার কিশোর বয়সে ওই গান ভাল লাগবে কেন ? তখন আমি কিশোর শুনছি, হেমন্ত শুনছি, পরের দিকে কুমার শানু শুনছি। পান্নালালকে কিছুটা বেসুরোই মনে হত। যত সময় এগোলো, গানগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গেল। কেন জানি না, গলাটা একটু একটু ভাল লাগতে শুরু করল। আমার সাধ না মিটিল, তুই নাকি মা দয়াময়ী, সকলই তোমারই ইচ্ছা, আমায় দে মা পাগল করে, আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে—এই সব গানগুলো নিজের মনেই গুনগুন করতাম।
পরে জানলাম, উনি ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভাই। আরও পরে জানলাম, মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন। যিনি এমন ভক্তিগীতি গাইতেন, তিনি নিজেকে এভাবে কেন শেষ করে দিলেন ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি। পরে নানা লোকের কাছে একটু একটু করে জেনেছি।
আগে দুই ভাইই নাকি শ্যামাসঙ্গীত ও আধুনিক- দুটোই গাইতেন। দাদা ধনঞ্জয়ের পরামর্শেই শ্যামাসঙ্গীতকেই বেছে নেন পান্নালাল। দুজনের মধ্যে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি হয়ে গেল। ফিল্ম ছাড়া ধনঞ্জয় শ্যামাসঙ্গীত গাইবেন না। আর পান্নালাল আধুনিক গাইবেন না। এই বোঝাপড়াটা ঠিকঠাকই চলছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর স্নেহে কোনও কার্পণ্যও ছিল না।
কিন্তু একটু নাম-ডাক হলে যা হয়! অনেক রকম বন্ধু জুটে যায়। তাঁরাই কান ভাঙাতে লাগলেন পান্নালালের । বোঝানো হল, তিনি আধুনিক গান গাইলে ধনঞ্জয়ের বাজার থাকবে না। তাই তিনি ভাইকে সরিয়ে দিলেন। অনেকে বলেন, পান্নালাল নাকি সেই সময় এরকম প্রচারে বিশ্বাসও করেছিলেন। ফলে, দুই ভাইয়ের বাক্যালাপই বন্ধ হয়ে গেল। পরে সেই দূরত্ব কিছুটা কমলেও মাঝের সেই ফাটলটা থেকেই গিয়েছিল।
কিছুটা যেন হতাশই হয়ে পড়েছিলেন। মাঝে মাঝেই শ্মশানে চলে যেতেন। নিজের মনেই বিড়বিড় করে কথা বলতেন। বলতেন, এত মা –এর গান গাইলাম, মা দেখা দিচ্ছে না কেন ? বাড়িতে তখন স্ত্রী ছাড়াও দুই মেয়ে। কিন্তু একটু একটু করে যেন সংসার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ছেন। একদিন নিলেন সেই চরম সিদ্ধান্তটা। কাউকে কিছু না জানিয়েই চিরতরে হারিয়ে গেলেন চেনা জগৎ থেকে।
৫২ বছর পেরিয়ে গেল। অনেক সাধ হয়ত মেটেনি। অনেক আশা পূরণও হয়নি। কিন্তু সব কি ফুরিয়ে গেল ? এখনও প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তাঁর গান ঠিক বেজে ওঠে। ফুরিয়ে যায়নি। সেই কণ্ঠ হয়ত অমরত্বই পেয়ে গেল।