‌ফুটবল ইতিহাসবিদরা যদি আরেকটু উদার হতেন!‌

কুণাল দাশগুপ্ত
করোনা আবহে একসঙ্গে যেন তিন ধাক্কা। বাংলার ফুটবলে ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবের শতবর্ষ। সারা দেশে, এমনকী দেশের বাইরেও ছড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ সদস্য–‌সমর্থক। সেই ক্লাবের শতবর্ষ ধুমধাম করেই হওয়া উচিত। কিন্তু তেমন কিছুই হল না।
জন্মের যদি শতবর্ষ হয়, তবে ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের পঞ্চাশ বছর। ১০৭০ এ ইরানের পাস ক্লাবকে হারিয়ে শিল্ড জয় ক্লাবের গর্বের মুকুটে অন্যতম সেরা পালক। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিজয়কীর্তি বলাই যায়। অথচ, এই পঞ্চাশ বছরও কেমন যেন নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল।
আর এবার। এল নতুন স্পন্সর। খুলে গেল আই এস এলের দরজা। করোনা আবহে সেই উচ্ছাসও যেন ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেল।
ক্রীড়া গবেষকরা যদি সত্যিই মনের দরজা- জানালা একটু ফাঁক করে রাখতেন, তাহলে পাস ক্লাব বিজয়ের পঞ্চাশ বছর যথেষ্ট রঙিন হতে পারত। করোনার বাজারেও। মাঠে ময়দানে হয়তো ঢল নামত না। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে মানুষের মনে ‘‌সত্তর’‌ ফিরে আসত।

east bengal3

১৯১১–‌র মোহনবাগানের শিল্ড জয় ঘিরে যে পরিমাণ গৌরবগাথা রচিত হয়েছে, তার পাঁচ শতাংশও হয়নি পাস বিজয়কে কেন্দ্র করে। তাই খুব খোঁজখবর রাখা ফুটবল ভক্ত ছাড়া পাস ক্লাবকে হারানোর কথা অনেকের অজানাই থেকে গেছে।
মোহনবাগানের ১৯১১ সালের শিল্ড জয়কে মহিমান্বিত করার পিছনে সঙ্গত কারণ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে বুটপরা গোরা সাহেবদের রাঙা মুখ কালো করে দেওয়াটা চাট্টিখানি কথা ছিল না। এটা লাল হলুদ সমর্থকরাও স্বীকার করতে কুণ্ঠা করেন না। ওই সময় ভারতীয়দের খেলার মাঠের ওই পরাক্রম ছিল অত্যন্ত জরুরি। দুশো বছরের দাসত্বের ফলে আত্মবিশ্বাসের যে অভাব তৈরি হয়েছিল ভারতীয় মননে, তা বদলানো শুরু হয়েছিল শিবদাস ভাদুড়ীদের জয়ের মধ্যে দিয়ে। অনেক হীনমন্যতা দূর করে দিয়েছিল ওই ঐতিহাসিক জয়। মাঠ ছাপিয়ে আত্মবিশ্বাস উপচে পড়েছিল রাজনীতির আঙিনাতেও। সাম্রাজবাদী ব্রিটিশদের ভিতে মোক্ষম আঘাত হেনেছিল মোহনবাগান। স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিকে একধাক্কায় যেন অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল।

এমনই ঘটনা ঘটেছিল স্বাধীনতার পরে ১৯৭০ সালে। শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের মুখোমুখি হয় ইরানের দুর্ধর্ষ পাস ক্লাব। ধারেভারে তারা এগারোর ইস্ট ইয়র্কের থেকে এগিয়েই ছিল। সেটা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ভিটে মাটি হারানো, সহায় সম্বলহীন মানুষের পাশে তখন বাম দল। আর ইস্টবেঙ্গল। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক প্রয়াত ক্ষিতি গোস্বামী এবং বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ইস্টবেঙ্গল শুধুমাত্র তাঁদের বোধের সঙ্গেই মিশে গিয়েছিল এমন নয়, মাঠে ইস্টবেঙ্গলের প্রতিটা জয় তাঁদের নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করত। অঞ্চলে ফিরে এসে লড়াই, সংগ্রামে উৎসাহ দিত। অধিকারের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, দাবি আদায়ের সংগ্রাম প্রাণ পেত ময়দানের লাল-হলুদ যোদ্ধাদের জান কবুল লড়াই-এর মধ্য দিয়ে।
দেশভাগ আর মুক্তি যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সর্বহারা উদ্বাস্তুর পাশে দাঁড়িয়ে যে বামপন্থী কর্মীরা লড়াই সংগঠিত করেছিলেন, তার অক্সিজেনের কেন্দ্রস্থল ছিল ওই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। তাই ওই সময়ের ইস্টবেঙ্গলের প্রতিটি সাফল্য পুষ্টি জুগিয়েছিল বাম আন্দোলনেও।

অথচ স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথম বিদেশি বধের ইতিহাসটি কেমন যেন সাদামাটা হয়েই রইল। পাস ক্লাবকে হারানো নিছক একটা ট্রফি জয় ছিল না। এর ব্যাপ্তিটা তার থেকে অনেক বেশি। সে ছিল ছিন্নমূল একটা জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ফুটবল ঐতিহাসিকরা এর আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট সেভাবে তুলেই ধরলেন না। এমনকী যাঁরা বাম আন্দোলনের ইতিহাস লিখে গেছেন, তাঁরাও যেন পাসকে বাইপাস করে গেছেন। নিছক বিস্মৃতি!‌ নাকি সমাজবিদরা সেই আবেগটাকে ধরতেই পারেননি!‌ এতে শুধু ইস্টবেঙ্গল নয়, ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসও কিছুটা বিবর্ণ হয়েছে। ‌পাস–‌বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে সেই ইতিহাস নতুন করে ফিরে দেখার চেষ্টা হোক। ‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.