‌শুশুনিয়ার প্রাচীন ওই শিলালিপির কাছে

অন্তরা চৌধুরি

বাঁকুড়ায় বাড়ি বলে যখন কেউ ‘বাঁকড়ি’ বলে খ্যাপাত, বড্ড রাগ হত। মনে মনে ভাবতাম, কেন আমার কলকাতায় জন্ম হল না! লাল মাটি ছাড়া বাঁকুড়ার আর আছেটাই বা কী? কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন নিজ জন্মভূমির বিস্ময় পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে। লকডাউনে দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পরে ফিরে গিয়েছিলাম নিজের দেশের বাড়িতে। নিজের প্রিয়জনদের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়েও ঘরবন্দি থাকতে কারই বা ভাল লাগে! ওদিকে শরতের নীল আকাশ, সবুজ ধানক্ষেতের ওপর কাশফুলের দোলা দেখের জন্য মন আমার হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই করোনার ভয়কে দূরে সরিয়ে বাড়ির সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম শুশুনিয়ার উদ্দেশ্যে। কারণ কাছে পিঠে বেড়াতে যাওয়ার ওই দু-একটি জায়গা আছে তার মধ্যে শুশুনিয়াই সবচেয়ে কাছে।

তবে শুধু পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়াটাই তো একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতিকে কাছে পাওয়াটাও একটা উদ্দেশ্য। তার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য খাওয়া। আসলে শুশুনিয়া সলগ্ন এলাকায় এমন বিচিত্র সব খাবার পাওয়া যায় যে তার জুড়ি মেলা ভার। এর আগে যতবারই শুশুনিয়া গেছি, ততবার ‘ধারা’ পর্যন্তই গেছি। টুকটাক পাথরের জিনিস কিনেছি। আর তার পরেই চলে এসেছি। ‘ধারা’ অর্থাৎ শুশুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হল বাঘের মুখ থেকে জল পড়া। আবহমান কাল ধরে এই জল পড়ে যাচ্ছে। সেই জল কোথা থেকে আসছে তার হদিশ আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি। আর এটা দেখতেই বহু দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। স্থানীয়দের মতে এই জল অত্যন্ত পবিত্র ও রোগপ্রতিরোধক। তাই সারাবছর ভিড় লেগেই থাকে। এই ধারার জল থেকে যে জলাশয়টি তৈরি হয়েছে, তার পাশেই ভানু-জহর অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা ‘আশিতে আসিও না’র শ্যুটিং হয়েছিল।

susuniya3

অনেক দিন ধরে শুনে আসছি শুশুনিয়া পাহাড়ের পেছন দিকে রাজা চন্দ্রবর্মার শিলালিপি আছে। এর আগে দু একবার যাওয়ার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু রাস্তাটি
এমন গোলোকধাঁধায় পরিপূর্ণ যে কোনও ড্রাইভারই আমাদের শিলালিপির কাছ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি। এবারে ঠিক করেছিলাম যাবই। বাড়ি থেকে বেরোতে প্রায় বিকেল সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছিল। রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত আর তাল গাছের সারির মাঝখান দিয়ে আমাদের ছোট্ট টোটো এগিয়ে চলেছে। ছোট ছোট জলাশয়ের ধারে অফুরন্ত কাশফুলের মেলা বসেছে। বিকেলের পড়ন্ত রোদে তার রূপ আরও মোহময়ী হয়ে উঠেছে। দিনের আলো পড়ে আসছে। শুশুনিয়া পাহাড়কে ডানদিকে রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম সেই প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজে। রাস্তায় দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিল। অবশেষে জঙ্গলের ভেতর কিছুটা রাস্তা পর্যন্ত টোটো উঠল। কিন্তু তার পর থেকেই শুরু হয়েছে পাথুরে রাস্তা। কাজেই এবার বাকি পথটা পায়ে হেঁটেই যেতে হবে।

প্রথমে বাড়ির সবাই উৎসাহী হয়ে বেশ কিছুটা পথ এসেছিল। কিন্তু রাস্তা আস্তে আস্তে দুর্গম হতে শুরু করল। জঙ্গলের ঘনত্ব আরও বাড়তে লাগল। তখন বাকিরা হাল ছেড়ে ফিরে গেল। পড়ে রইলাম আমাদের মত অত্যুৎসাহী কয়েকজন যাঁদের শরীরের জোরের তুলনায় মনের জোর অনেকটা বেশি। আমরাও ভেবেছিলাম শিলালিপিটা হয়ত কাছাকাছিই কোথাও হবে। কিন্তু হাঁটছি তো হাঁটছি। শিলালিপির কিন্তু দেখা নেই। ইতিহাস আবিষ্কারের নেশা তখন পেয়ে বসেছে। এদিকে সূর্য পাটে বসেছে।
জঙ্গলের মধ্যে ঝুপ করেই সন্ধ্যে নামে। আলোর ভগ্নাংশটুকুই তখন আমাদের একমাত্র ভরসা। পাহাড়ে ওঠার রাস্তা ক্রমশঃ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হতে লাগল। আশ্বিনের গরমে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর বারবার বিদ্রোহ ঘোষণা করতে লাগল। অনেকবারই হাল ছেড়ে দিলাম। নাহ্! আর পারছি না। পরের বার শীতকালে আসব। কিন্তু এত সহজে ব্যর্থতাকে মেনে নেব! এত কাছে এসে ফিরে যাব! তা হয় না।

silalipi2

তাই আবার উঠতে শুরু করলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, উঠছি তো প্রবল উৎসাহে। কিন্তু নামার সময়! একটা জায়গায় তো এসে পেছন ফিরে দেখি কোথাও আর রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। শুধুই গাছ আর গাছ। আদি অকৃত্রিম জঙ্গলের মাঝে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। তারপর আরও কিছুটা দুর্গম পথ চলার পর অবশেষে দেখা মিলল সেই টিন আর জালতি দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট ঘর। বুঝলাম এখানেই রয়েছে সেই প্রাচীন শিলালিপি।

দিনের আলো তখন নিভে এসেছে। মোবাইলের আলোই তখন একমাত্র ভরসা। শরীরের ক্লান্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম সেই শিলালিপি।সাহিত্যের ছাত্রী হলেও ইতিহাসের প্রতি একটা দুর্বলতা আছেই। সেই আলো আঁধারীতে ঘেরা রহস্যময় পরিবেশে আমরা তখন এক দুর্লভ ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। সে যে কী রোমাঞ্চ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অজন্তা ইলোরা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু আমার নিজের জেলাতেই যে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর এইরকম একটা নিদর্শন রয়েছে, সেটা ভাবতেই কেমন শিহরণ হচ্ছিল। মাত্র তিনশো বছরের পুরনো কলকাতার কত অহংকার। অথচ আমার এই জেলা কত প্রাচীন! মনে মনে ভাবছিলাম কেমন ছিলেন সেই রাজা চন্দ্রবর্মা যিনি সমুদ্রগুপ্তের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই দুর্গম শুশুনিয়া পাহাড়ে দুর্গ তৈরি করে সেখানে বাস করতেন। যদিও সেই দুর্গের কোনও অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পালি ভাষায় লেখা শিলালিপিটি বড় অদ্ভুত। লিপিটিতে চন্দ্রবর্মার কীর্তি খোদাই করা আছে। লিপিটিতে দুটি অংশ রয়েছে। উপরের অংশে থাকা বৃত্ত থেকে কতকগুলি রেখা বেরিয়ে এসেছে। এই রেখাগুলিও একটি চক্র দিয়ে ঘেরা। এই অংশটি চন্দ্রবর্মার শীলমোহরের প্রতীক। আর এই বৃত্তের সমান্তরালে থাকা আরও একটি বৃত্ত থেকে চোদ্দটি অগ্নিশিখা বেরিয়েছে। প্রতিটি অগ্নিশিখার পরে দুটি অর্দ্ধবৃত্ত রয়েছে। পন্ডিতদের মতে এটি ‘বিষ্ণুচক্র’।
লিপিতে খোদিত অংশের পাঠদ্ধার করলে পাওয়া যায়- ‘পুষ্করণাধিপতে মহারাজশ্রীসিঙ্ঘবর্মণঃ পুত্রস্য/মহারাজশ্রীচন্দ্রবর্মণ
কৃতিঃ/চন্দ্রস্বামিন দাসাগ্রেণাতি সৃষ্টঃ’।(পুষ্করণার অধিপতি মহারাজ শ্রীসিংহবর্মার পুত্র মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মার কীর্তি। চক্রস্বামী অর্থাৎ বিষ্ণুর অগ্রদাসের দ্বারা সৃষ্ট)।
অজানাকে জানার অদেখাকে দেখার আগ্রহ মানূষের চিরকালের। এতবছর বাঁকুড়ায় বসবাস করা সত্ত্বেও এইরকম একটা দুর্লভ ইতিহাসের সন্ধান পাইনি ভাবতেই কেমন লজ্জা হচ্ছিল। এবার ফেরার পালা। আকাশে তখন ষষ্ঠীর চাঁদ উঠেছে। সেই আলোই আমাদের একমাত্র ভরসা। পাহাড়ী রাস্তায় ওঠার থেকেও নামাটাই সব চাইতে বিপজ্জনক। তার ওপর বৃষ্টি হওয়াতে পাথরে পাথরে শ্যাওলা জমেছে। চন্দ্রবর্মাকে সেদিনের মতো বিদায় জানালাম। তাঁর স্থাপত্য, বিজয় কীর্তি সব কিছুই সেই বিজন বনে একাকী পড়ে রইল। মানুষ চলে গেলেও মানব থেকে যায়।

silalipi3

আমাদের মতো কিছু মানুষের ‘কী আছে’ জানার আগ্রহেই সেই শিলালিপি জীবন্ত হয়ে ওঠে বারবার। চন্দ্রবর্মার বিজয়কীর্তি হয়ত কাউকে স্পর্শ করে; কাউকে বা করে না। তবুও সেই দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গলে সেই প্রাচীন ইতিহাস আজও একাকী ফিসফিস কথা কয়। যখন পাহাড় থেকে নামলাম তখন চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। জোনাকীর আলো ছাড়া আর কোথাও কোনও আলোর রেশ মাত্র নেই। ভয়ের চোটে বাড়ির লোকের মুখ শুকিয়ে গেছে। তারপর সেখান থেকে শুশুনিয়ার ধারার জলে স্নান সেরে টুকটাক কেনাকাটার পর্ব চলল। রাস্তায় টোটো থামিয়ে লন্ঠণের আলোয় কখনও খাওয়া হল গ্রামীণ ফুচকা, কখনও পিঁয়াজ রসুন দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট সিঙাড়া। আহা! কী অপূর্ব সেই স্বাদ! অবশেষে ছাতনার বিখ্যাত পেড়া কিনে বাড়ি ফেরা হল। রাস্তার দুপাশে অন্ধকার হলেও জোনাকীদের রংমশাল দেখতে কী ভালোই লাগছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, চন্দ্রবর্মার শিলালিপি তো দেখলাম। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম কই! আচ্ছা অতবছর আগে ওই রকম দুর্গম জায়গায় শিলালিপিটা খোদাই বা কে করেছিল। তাঁর তো কোথাও নাম নেই।
বাড়ি ফিরে সবজান্তা গুগল মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলাম চন্দ্রবর্মা সম্পর্কে।তিনি যে খুব একটা সদুত্তর দিতে পারলেন তা নয়। তবুও যেটুকু দিলেন তার সারমর্ম এইরকম-
ইতিহাস অনুযায়ী রাজা সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিসেন রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তিতে কথিত আছে, যে ন’জন রাজাকে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছিলেন চন্দ্রবর্মা তাঁদের একজন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে চন্দবর্মার রাজত্বকালের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন বাঁকুড়ার বড়জোড়ার কাছে অবস্থিত পুষ্করণার অধিপতি। রাজা চন্দ্রবর্মা বিষ্ণুপদগিরিতে বিষ্ণুর ধ্বজা স্থাপন করেছিলেন। ভারতে গয়াক্ষেত্রে ও রাজস্থানের পুষ্করে বিষ্ণুপদগিরি আছে। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘এই বিষ্ণুপদগিরি পুষ্করে হওয়াই অধিক সম্ভব’। তবে তাঁর বংশধরের কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.