- নন্দ ঘোষের কড়চা
আপনি নাকি বিদ্যাসাগর। তা, এমন নামটি কে দিয়েছিল মশাই? যেই দিয়ে থাকুক, আপনি একবারও বারণ করলেন না? সবাই আপনাকে দিব্যি বিদ্যাসাগর বলে চিনে গেল। আপনি মনে মনে বেশ মজা পেলেন। পদবী উড়ে গেল। নতুন পদবী এসে গেল।
বিদ্যা নাকি বিনয়ী করে। আপনার তো মশাই অনেক বিদ্যা ছিল। তাহলে বিনয়ী হননি কেন ? কেন নিজেকে বিদ্যাসাগর বলে ঢাক পেটাতেন? একবার তো বারণ করতে পারতেন।
আপনার সঙ্গে মশাই একজনের খুব মিল পাচ্ছি। একটা সুলভ শৌচাগার উদ্বোধন করতে গিয়েও পাড়ার কাউন্সিলরদের বলতে হয়, অমুকের অনুপ্রেরণায় জনসাধারণের জন্য এই শৌচাগারটি করা হল। সব বিজ্ঞাপনে তাঁর বড় ছবি। বড় বড় হোর্ডিংয়ে তিনি। তিনি একবার বারণ করলেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি বারণ করেন না। শুনেছি, কোন ছবিটা কোন বিজ্ঞাপনে যাবে, নিজে নাকি বেছে দেন। তিনি সবার অনুপ্রেরণা। এখন বুঝছি আসল নাটের গুরু আপনি। আপনি বোধ হয় তাঁর অনুপ্রেরণা।
আপনি নাকি মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দামোদর পেরিয়েছিলেন। যারা দুর্গাপুর ব্যারেজ দিয়ে পেরিয়েছে, তারা ভাবে দামোদর মানে বোধ হয় বিশাল কিছু। আপনি যে দামোদর পেরিয়েছেন, সেটা মোটেই চওড়া নদী নয়। টালি নালার থেকে একটু বড়। সেই নদী পেরিয়ে এত বলার কী আছে মশাই? যারা আপনাকে নিয়ে তিন-চার লাইন জানে, তারাও জানে আপনার নদী পেরোনোর কথা। এই বাংলার কত লোক ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে গেল, কেউ তাঁদের খোঁজও রাখে না। আর আপনি একটা নালার মতো নদীর পেরিয়েছেন (সত্যি কিনা সন্দেহ আছে), সেটা কিনা টেক্সট বুকে এসে গেল। এবার বুঝছি, কেন কেউ কেউ নিজেকে সিলেবাসে আনতে চাইছেন। এটাও বুঝছি, এখন যারা এটা সেটা অঙ্গভঙ্গি করে রিল বানায় আর সেগুলো ভাইরাল করে, তাদেরও উৎসাহদাতা সেই আপনি।
কলকাতা আসতে আসতে মাইলস্টোন দেখে আপনি নাকি সংখ্যা চিনেছিলেন। ভাবুন, কত পিছিয়ে ছিলেন। এখন দু বছরের এক ছোকরা কিনা মোবাইল গেমস খেলছে। চার বছরে চ্যাট, হোয়াটস আপ করছে। মোবাইলে ম্যাপ দেখে সে বলে দেবে, কলকাতা কত দূরে।
কোন এক সাহেবের মুখের উপর আপনি টেবিলে জুতো তুলে বসেছিলেন। সেই সাহেব নেহাত ভদ্রলোক ছিল। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়েছিল। এখন শিক্ষাবিভাগ আলো করে কারা বসে থাকে, আপনি জানেন! তাঁদের সামনে ওইভাবে বসলে কোথায় বদলি হতেন, কে জানে! সন্দীপ ঘোষের মতো স্বনামধন্য প্রিন্সিপালের পাল্লায় তো পড়েননি। উনি হয়তো শুনিয়ে দিতেন, ‘এটা কিন্তু আরজি কর/ ফিরে যাও নিজের ঘর’। অথবা হয়তো বলে বসতেন, ‘লিখেছিস বর্ণমালা?/তুই আবার কোন শালা?’ কলেজে কলেজে যা থ্রেট সিন্ডিকেট, কোনও ‘দায়িত্বশীল’ ছাত্রনেতা ঢুকলে, হাড়ে হাড়ে টের পেতেন। আপনার হাড় হিম হয়ে যেত।
হয়ত আপনার ভোটে দাঁড়ানোর শখ হল। আপনার বীরসিংহগ্রাম কোথায়? খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ঘাটালের কাছাকাছি। সেখান থেকে আপনি টিকিট পেতেন? কোনও চান্স নেই। ওখানে ‘দেব’ আছে। দেব থাকতে লোকে আপনাকে টিকিট দেবে কেন? অতএব, আপনাকে থাকতে হত ‘নিষ্ফলের, হতাশের দলে’। নইলে ‘আঙুর ফল টক’ এর মতো বলতে হত, ‘রাজনীতি খুব খারাপ জিনিস’।
রাতে ঘুমিয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় আপনি টিকি বেঁধে রাখতেন। যেন ঘুমিয়ে গেলেই টান পড়ে। এখন কাউকে টিঁকি বেঁধে রাখতে হয় না। ওরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। বিশ্বাস না হলে, গভীর রাতে ওদের ফেসবুক বা হোয়াটস আপ স্ট্যাটাস দেখুন। দেখতে পাবেন, ‘অনলাইন’। আপনি অবশ্য পুরানো যুগের মানুষ। এসব বুঝবেন না।
আপনি নাকি ল্যাম্প পোস্টের নিচে বসে পড়তেন। সত্যিই, আপনার কত নিষ্ঠা! নিষ্ঠা না ঘোড়ার ডিম। এটুকু বলতে পারি, বই হাতে আপনার যত না নিষ্ঠা ছিল, স্মার্টফোন হাতে এই ছোকরাদের ‘নিষ্ঠা’ আপনার থেকে ঢের বেশি। আপনার তবু ল্যাম্প পোস্টের আলো দরকার হত। এদের আলোর দরকার হয় না। আলো না থাকলেও এদের নিষ্ঠায় কোনও ঘাটতি আসে না।
তাহলে কী দাঁড়াল। আপনি একাই বিদ্যাসাগর নন। আপনার মতো বিদ্যাসাগর এখন পাড়ায় পাড়ায়। তাহলে খামোখা আপনাকে মহাপুরুষের আসনে বসাবো কেন ?
*****
(নিছকই একটি মজার কলাম। বিদ্যাসাগরকে অসম্মান করার বা ছোট করার কোনও ইচ্ছে থেকে এই লেখা নয়। এই লেখাকে মজা হিসেবেই দেখুন। এই লেখা থেকে যেন কোনও ভুল বার্তা না যায়।)