যেদিন খুশি লকডাউন ডাকলেই হল!‌

স্বরূপ গোস্বামী

আপনার বাড়িতে কোনও বিয়েবাড়ির তারিখ ঠিক করার আগে কী কী দেখেন?‌ পঞ্জিকা মতে বিয়ের শুভদিন বেছে নেওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু তার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় বাড়ির কর্তাদের মাথায় রাখতে হয়। সেই সময় বাড়ির বা আত্মীয়দের ছোটদের পরীক্ষা আছে কিনা। কারও গুরুতর অপারেশন হতে পারে কিনা। বাড়িতে বা নিকট আত্মীয় কোনও প্রসূতি থাকলে তাঁর সম্ভাব্য ডেলিভারির ডেট কখন। মোটামুটি এগুলো মাথায় রেখেই বিয়ে বা অনুষ্ঠানের দিন ঠিক করা হয়।

open forum4

কিন্তু সরকারের সেসব ভাবার কোনও দায় নেই। তাঁরা ইচ্ছেমতো তারিখে পরীক্ষার দিন ফেলেন। আবার ইচ্ছেমতো তারিখে লকডাউন করেন। আবার ইচ্ছে মতো তা তুলেও নেন। তারিখ বাছার পেছনে বা তুলে নেওয়ার পেছনে অধিকাংশ সময়ই যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তারই সাম্প্রতিক নমুনা ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বরের লকডাউন। আপাতভাবে মনে হতেই পারে, পরপর দুদিন লকডাউন তো হতেই পারে। আগেও হয়েছে। এর মধ্যে অন্যায়টা কোথায়!‌

কিন্তু মুশকিলটা হল, ১৩ সেপ্টেম্বর জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষা। এই রাজ্য থেকে প্রায় এক লাখের কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার্থী। আগে জেলায় জেলায় সেন্টার পড়ত। ফলে, এক জেলার পরীক্ষার্থীকে অন্য জেলায় সচরাচর যেতে হত না। কিন্তু সর্বভারতীয় নিট পরীক্ষায় জেলায় জেলায় সেন্টার নেই। মূলত, কলকাতা, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি–‌এসব বড় বড় শহরে সেন্টার। ফলে, দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করে যেমন চার পাঁচটি জেলার পরীক্ষা, ঠিক তেমনি কলকাতাকে কেন্দ্র করেও অন্তত ছ–‌সাতটি জেলার পরীক্ষা।

রবিবার পরীক্ষা থাকলে পরীক্ষার্থীরা সাধারণত একদিন আগেই কলকাতা চলে আসে। কেউ কেউ তো শুক্রবার চলে এসে শনিবার আগে সেন্টার দেখে আসে। তারপর রবিবার পরীক্ষা দিতে যায়। যখন বাস, ট্রেন সব স্বাভাবিক থাকে, তখনই একদিন আগে আসত। এখন তো ট্রেন বন্ধ। বাস সংখ্যায় নিতান্তই কম। এই অবস্থায় তারা আরও বেশি সতর্ক হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শনিবার যদি বাস বন্ধ থাকে, তারা আসবে কী করে!‌ সবার পক্ষে তো রবিবার দশ–‌পনেরো হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া করে আসা সম্ভব নয়।

পরীক্ষার্থীর মানসিকতাটাও তো বুঝতে হবে। সে একদিন আগে এসে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। পরের দিন ভোরে বেরোতে হবে জানলে আগের রাতে তার পরীক্ষার থেকেও বড় টেনশন হয়ে দাঁড়ায় কীভাবে সে কেন্দ্রে পৌঁছবে। মুর্শিদাবাদ বা নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যে পরীক্ষা দিতে আসবে, সে কীভাবে পৌঁছবে?‌ কাকদ্বীপ, আরামবাগ, মেদিনীপুরের ছেলেরাই বা কীভাবে পৌঁছবে?‌ এ নিয়ে সরকারের কোনও চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না।

কীভাবে মেট্রো চলবে, তা নিয়ে গত কয়েকদিনে কত বৈঠক, কত চর্চা। কিন্তু কলকাতার থেকেও অনেকগুন বেশি পরীক্ষার্থী আসবে জেলা থেকে। মেট্রো চলাচলের সঙ্গে তাদের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে, যাঁরা সরকার চালাচ্ছেন, তাঁরা চিন্তায় চেতনায় একেবারেই কলকাতা কেন্দ্রিক। তার বাইরেও যে একটা বৃহত্তর বাংলা আছে, তা নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথাই নেই।

রবিবার এমন একটা সিরিয়াস পরীক্ষা। এটা জানার পরেও কেউ শুক্র–‌শনি লকডাউন ডাকে!‌ মন্ত্রী–‌আমলারা জানতেন না, এটাই বা বিশ্বাস করি কী করে!‌ কারণ, এই পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সরকার উদ্যোগী হয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিল। সেই পরীক্ষার তারিখ তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তবে কি সরকার চাইছে যেন, অধিকাংশ পড়ুয়া পরীক্ষায় না বসতে পারে!‌ কী জানি, সেটাকেও হয়ত মুখ্যমন্ত্রীর সাফল্য বলে প্রচার করা হবে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ত ঘটা করে প্রেস কনফারেন্স করবেন, ‘‌আমি তো আগেই বলেছিলাম পরীক্ষা বাতিল হোক। অধিকাংশ পরীক্ষার্থী আসেনি। প্রমাণ হয়ে গেল, আমি যেটা বলছিলাম, সেটাই ঠিক।’‌ শুনতে অবিশ্বাস্য লাগছে। কিন্তু এমন ভুরি ভুরি প্রেস কনফারেন্সের নজির আছে।

open forum3

বরং এই কঠিন সময়ে সরকারের আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়া উচিত। অন্য সময়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নিজেরাই হোটেল খুঁজে নেন। বা কোনও আত্মীয় বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু এই কঠিন সময়ে আত্মীয়রাও হয়ত সেভাবে স্বাগত জানাবেন না। অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তাছাড়া, তাঁদের বাড়িতে যেতে পরীক্ষার্থী বা তার অভিভাবকেরও সঙ্কোচ হতে পারে। বা গেলেও নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে হতে পারে। তাই, তাদের থাকার ব্যবস্থা সরকারই করতে পারত। না হয় টাকার বিনিময়েই যুব আবাস বা এই জাতীয় থাকার জায়গা খুলে দেওয়া যেত। একুশে জুলাই লাখ লাখ মানুষের থাকা–‌খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। আর এই পরীক্ষায় মাত্র কয়েক হাজার পরীক্ষার্থীর ব্যবস্থা করা যায় না!‌ একটু সদিচ্ছা থাকলে আর একটু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকলেই করা যায়। কিন্তু সরকার সেই সদিচ্ছা দেখাবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু লকডাউন!‌ সেটা তো তোলা যায়!‌ অন্তত পিছিয়ে তো দেওয়া যায়। তখন না হয় ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু পরে তো শুধরে নেওয়া যায়। কলেজে কলেজে টিএমসিপির সমাবেশ হবে বলে, মুখ্যমন্ত্রী ভাষণ দেবেন বলে ২৮ আগস্টের লকডাউন পিছিয়ে দেওয়া যায়। এতবড় একটা পরীক্ষার আগে লকডাউন স্থগিত রাখা যায় না! কেউ কেউ হয়ত কটাক্ষ করবে। করুক। একটা ভুল শুধরে নিতে গিয়ে যদি সমালোচনা হয়, হোক। অন্তত এই ভুলটুকু শুধরে নিলে সরকারের মাথা হেঁট হবে না। বরং, কিছুটা উজ্জ্বলই হবে। বরং এরপরেও জেদ আঁকড়ে থাকাটাই গোঁয়ার্তুমি হবে। সরকারকে ঠিকঠাক বুদ্ধি দেওয়ার লোকের এতই অভাব!‌ এই দায়িত্বটা বিরোধীরা নিতে পারতেন। মূলস্রোত মিডিয়া নিতে পারত। তারাও বিষয়টার গুরুত্ব হয় বুঝছে না। নইলে, অকারণ ভয় পাচ্ছে। তাঁরাও বরং এই বিষয়কে কেন্দ্র করে একটু আত্মসমীক্ষা করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.